চলতি পাঠ – ২

কিছুকাল যাবৎ মন বিশেষ ভালো নহে । গেল বৎসর শরতে, চাকুরি ছাড়িয়া উচ্চতর ডিগ্রি লাভের আশায় স্বদেশ ছাড়িয়া পশ্চিমা মুলুকে আসিয়াছি; প্রথম প্রথম নূতন নূতন সকলি ভালো লাগিতেছিল । কিন্তু দিনে দিনে যেন দেশ হইতে দূরত্ব কেবলি বাড়িতে থাকিল আর বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-পরিজনের নৈকট্যলাভের সাধ জ্যামিতিক হারে বাড়িতেই থাকিল । গত দু-তিন সপ্তাহে মিডটার্ম চলিতেছে, অর্থাৎ পরীক্ষা চলিতেছে; পরীক্ষা জীবনে কোনকালেই মনপূত হয় না – তবে পরীক্ষা লইয়া অনুযোগ আর বিরাগ হওয়াও আমার স্বভাব নহে । কিন্তু, বাঁধ সাধিতেছে বন্ধুত্বের অভাব । যেকালে, কুয়েটে পড়িতাম সেকালে চারিদিকে বাস করিত নানাবর্ণের বন্ধুবান্ধব, এখন তাহা নাই । গোটা স্টোনিব্রুকে (আমার যেখানে বাস ও পাঠ) বাংলাদেশি স্নাতক শিক্ষার্থী আছি আমরা হাত গুণতি বারো তের জন । শিক্ষাজীবনেই কহ আর চাকুরি জীবনেই কহ, আড্ডাবাজি আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে । দেশ, কাল, জাতি, খেলা ইত্যাদি লইয়া মন খুলিয়া আড্ডাবাজি করাটাই আমার জীবনের লক্ষ্য বলিয়ে প্রতিভাত হইত ।

যাহা হৌক, কিছুকাল ধরিয়া দেশ, জাতি, ক্রীড়া ইত্যাদি লইয়া নানাকিছুই আমাকে সম্যক পীড়া দিতেছে । দেশ লইয়া হতাশা ব্যক্ত করিতে কাহারো ভালো লাগে না, আমার তো নহেই । তবুও, দেশের কতিপয় নয় বরং অনেক কিছু লইয়াই আমি চিন্তিত । আজিকে, বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণার ৪৩ বর্ষ পূর্ণ করিতে যাইতেছে । আমি যখন বৈদেশে আসি, সেকালে দেশে চূড়ান্ত রাজনৈতিক অস্থিরতা চলিতেছিল; এই বৎসরের শুরুতে তাহা স্তিমিত হইলেও সমস্যা যাহা ছিল তাহার কোন সমাধান সাধিত হয় নাই । দেশের প্রধান বিরোধী দল, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নাই; আজিকাল ফেসবুক ব্যাতীত আর কোথাও তাহাদের এমনকি চিহ্নও খুঁজিয়া পাওয়া যাইতেছে না । দেশে, একই দল, পরপর দুই সংসদে সরকার গঠণ করিয়াছে, দেশের উন্নতি, প্রগতির ধারা ধরিয়া রাখিবার জন্য ইহা খুবই সহায়ক । চিন্তিত হইতেছি ইহা ভাবিয়া, যে দেশে যে সংসদ সরকার গঠন করিল তাহা তেমন কোন ভোটই অর্জন করিল না; এবং তাহা লইয়া জনগণের তেমন কোন উচ্চবাচ্য নাই । ইহাতে, একটি জিনিসই প্রতীয়মান হয়, আর তাহা হইল, আমরা যতই দেশ দেশ করিয়া থাকি না কেন, আদতে জাতি হিসেবে আমরা দেশসচেতন নহ । দেশের সরকার কি করিবে তাহা লইয়া আমরা কালেভদ্রে ম্যাৎকার করিলেও আসলে দেশ লইয়া আমাদিগের তেমন কোন পরোয়া নাই । চারদশক পার করিয়া আমরা একটি দেশে বসবাস করিতেছি, যাহাতে গণতন্ত্র ঠিকমত প্রতিষ্ঠা পায় নাই । ইহা মানিয়া লইলাম; কিন্তু পীড়িত হই তখন, যখন দেখি আমাদিগের অর্থনৈতিক কাঠামো খুবই পর্যদুস্ত । আমাদিগের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যাহাকিছু আছে সকলি ভোগকেন্দ্রিক, উৎপাদন কেন্দ্রিক নহে । শুধু তাই নহে, দেশের অবস্থাও খুব বিনিয়োগবান্ধব নহে । উৎপাদন না হইলে দেশের সম্পদ কেবলি কমিতে থাকিবে আর দেশের উন্নতি ধূসর থেকে ধূসরতর স্বপ্নে পরিণত হইতে থাকিবে ।

দেশ লইয়া বিশেষ আমোদিত হইতে পারিতেছি না বলিয়া কিয়দকাল ধরিয়া ক্রিকেট ম্যাচসমূহ দেখিতেছি, যদি তাহাতে কিছু আনন্দলাভ হয় । কিন্তু তাহাতেও বিধিবাম । প্রথম এশিয়া কাপে, কোন ম্যাচ জিতিতে পারিলাম না, এমনকি সহজসাধ্য আফগানিস্তানের নিকটও হারিয়া টুর্নামেন্টে কোন ম্যাচ না জিতিবার অসাধারণ রেকর্ড গড়িলাম । ভাবিলাম, যাহা হৌক এই টুর্ণামেন্ট হইতে শিক্ষা লইয়া টি২০ তে ভালো করিব । সেক্ষেত্রেও আবারো হংকং এর নিকট পরাজিত হইয়া, কোয়ালিফাইং রাউন্ড খেলিবার প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করিয়া কোনরকমে মূল রাউন্ডে উঠিলাম বটে; প্রথম ম্যাচে আজিকে যাহা খেলিলাম তাহাতে মন বিষাদগ্রস্ত না হইবার কোন কারন খুঁজিয়া পাই না । দেশে থাকিলে, কতিপয় বন্ধুবান্ধব লইয়া কিয়দক্ষণ মাতম করিতাম – এইখানে তাহা হইলো না ।

চলতি কথন যেহেতু লিখিতেছি, চলতি আলোচ্য জাতীয় সঙ্গীতের রেকর্ড লইয়াও কিছু কথা উল্লেখ না করিলেই নহে । ছোটকালে যখন স্কুলে যাইতাম, আর প্রতিদিন প্রাতে শ্যামল ঘাষের মোলায়েম মাঠে “আমার সোনার বাংলা” গাহিয়া উঠিতাম, আর সকলের সুরের মধ্যে আমার সুরহীন গীতি হারাইয়া যাইত, আর সঙ্গীতের অনাবিল সুরে মনখানা নাচিয়া উঠিত । কিন্তু, লক্ষ মানুষ একত্রিত হইয়া গাহিলে কী এমন লাভ সাধিত হইবে, এবং তাহা করিতে কেন অর্ধশতাধিক কোটি টাকা খরচ হইবে তাহ বুঝিতে পারি না । আয়োজনের নানাবিধ সমস্যা আর দেশপ্রেমের চাকচিক্যসার প্রদর্শণ লইয়া দেশের মানুষের নানাবিধ আপত্তি ও আলোচনায় চাপা পরিয়া জাতীয় সঙ্গীত সম্ভ্রম হারাইতেছে । মনখুলিয়া গান গাইবার যে আত্মপ্রসাদ তাহার বানিজ্যিকরণের এই বোধকরি সমস্যা ।

কিয়দকাল পূর্বে মালয়শিয়ান এয়ারের একখানা বিমান হারাইয়া গেল । ইহার সন্ধান নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত জনমনের ন্যায় আমারও প্রশ্ন ছিল বিমানখানি গেল কোথা’! । গতকাল যখন শুনিলাম ইহা ভারত মহাসাগরে বিলীন হইয়াছে, প্রথমবারের মত মনে হইল, কয়েকশত মানুষ মারা গিয়াছে ও তাহাদিগের সলিল সমাধি হইয়াছে । সকলের আত্মার মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করিতেছি । আমার জানামতে, কোন পরিচিতজনের আত্মীয় তাহাদিগের মধ্যে ছিল না । কিন্তু আমাদিগের পরিচিতজন কেহ থাকিতেও পারিত ।

সকলকে মহান স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা ও এই দিবস উপলক্ষ্যে দেশের সর্বোত মঙ্গল কামনা করিয়া আজিকার মতন ইতি টানিতেছি ।

Published by

nafSadh

I study theory and applications of computing sciences.

2 thoughts on “চলতি পাঠ – ২”

  1. জাতীয় সঙ্গীত সম্ভ্রম হারাইলে কোন সমস্যা নাই। মানুষ অধিকার ও মর্যাদা হারাইতেছে-এইটাই সমস্যা।

    Like

Leave a comment