চাঁদের হরণ

বাঙালি সর্বদাই দড় রোমান্টিক, সৌন্দর্যরস তাহাদের প্রবল, সেইসাথে প্রকট তাহাদের উপমার বাহার। আম্মো বাঙালি, তাই আমিও কম যাই না বাঙালির এইসব গুণে! যাহা হউক, আমরা চন্দ্র-কে বড়ই পেয়ার করিয়া থাকি; উন্মাতাল সৌন্দর্য, নিরূপম নিষ্কলঙ্ক লাবণ্য ইত্যাদি বহুগুণ রূপ বুঝাইতে আমরা চাঁদবদনের উল্লেখ করিয়া থাকি। আবার, আমরা জ্ঞাতি গোষ্ঠীতে চাঁদ মিঞা, অমুক “চন্দ্র” তমুক কিংবা কিষাণ চন্দর – মানবসন্তানের ইত্যাকার বিবিধ নামও শুনিয়া থাকি। চন্দ্রাবতী, চাঁদনী এরূপ নামও বৈ কম নাই। আবার ইতিহাসের পাতা উল্টাইলে দেখা যাইবে যে, চন্দ্র বংশ নামীয় এক রাজবংশ আমাদের ভূমিতে শাসন করিত। আজকাল চলিত ভাষার ব্যবহারে চন্দ্র শব্দ হারাইয়া যাইতেছে, তদস্থলে “চাঁদ” আর কথ্য ভাষায় কখনোবা “চাঁন” এরকম শব্দ অধিক শ্রুত হয়। স্মৃতি হাতড়ে দেখি, শৈশবে ব্যাকরণের বাগধারা অধ্যায়ে আমরা “অর্ধচন্দ্র দান” বচনখানি অধ্যয়ন করি যাহার অর্থ গলা-ধাক্কা দিয়া তাড়াইয়া দেওয়া।

আজিকে শুনিলাম, আকাশের যে চাঁদ – ধবধবে সফেদ চন্দ্র, তাহাকে নাকি কে হঠাৎ অর্ধচন্দ্র দিয়া আকাশ হইতে খেদাইয়া দিবে! কি বিচিত্র কথা। আজিকে পূর্ণিমা – অর্থাৎ কিনা পূর্ণচন্দ্র, পূর্ণচন্দ্রকে দিবে অর্ধচন্দ্র! নাহ্‌, হাসিয়া বাঁচি না। এইরকম খবর শুনিয়া, সিদ্ধান্ত লইলাম, সারারাত্র বসিয়া আকাশপানে চাহিয়া দিইব চন্দ্র প্রহরা। চাঁদমামুকে লইয়া যাইতে দিব না কিছুতেই।

আকাশ হইতে চন্দ্র হারাইয়া যাইবার ঘটনা-কে অনেকে বলে চন্দ্রগ্রহণ, আমি কইব চন্দ্রহরণ। হিন্দু পুরাণে ইহার উল্লেখ রইয়াছে, বলা হয় রাহু চন্দ্র কে গিলিয়া খাইলে চন্দ্রগ্রাস হয়। বিবিধ উপাখ্যান হইতে জানা যায় যে:
রাহু হইতেছে মায়াদানবের ভ্রাতা দানব বিপ্রচিত্তি’র ও সিংহিকার সন্তান। সমুদ্রমন্থন হেতু অমৃত উঠিয়া আসিলে, দেবগণ তাহা খাইবার মনস্থির করে; কিন্তু সেইরূপ করিবার পূর্বেই রাহু অমৃত পান করিতে শুরু করিয়া দেয়। রাহু অসুর বলিয়া সে অমৃতের ভাগ পাইবে না, এবং রাহুর এহেন কীর্তির কথা চন্দ্রদেব ও সূর্যদেব রাষ্ট্র করিয়া দেয়; তৎক্ষনাত বিষ্ণুর স্ত্রীরূপধারী অবতার মোহীনি রাহুর শিরচ্ছেদ (নাকি ধরচ্ছেদ) করিয়া দেয়। ততক্ষণে অমৃত কিছু মাথা ও গলদেশে থাকিয়া যাওয়ায় রাহুর মাথা অমর হইয়া যায় কিন্তু ধর মরিয়া যায়। তারপর হইতেই ক্ষোভবশত রাহু নিয়মিত চন্দ্র ও সূর্য কে গ্রাস করিয়া শোধ লইতেছে। ইহাই হইতেছে চন্দ্রগ্রহণের একখানা বহুকাল যাবৎ জানা মূল রহস্য।

এই উপাখ্যান ছিল ভালো ছিল, কিছুকাল পূর্বে বিজ্ঞানীগণ আসিয়া ভিন্নতর কারন ব্যাখ্যা করিলেন। বিজ্ঞানীদিগের লইয়া এই এক যন্ত্রণা, সবকিছুতেই তাহারা যুক্তি দিয়া ব্যাখ্যা করিয়া আসল কাহিনী জানাইয়া দিতে চান। তাহারা কহেন, পৃথিবী ও চন্দ্রের গতিপথ এইরূপ যে, পূর্ণিমার কালে চন্দ্র, সূর্য ও পৃথ্বী একই রেখায় থাকে এবং কখনোবা তাহার সমপাতিত হইয়া যায়। আর তা হইলেই দুনিয়া চন্দ্রকে ঢাকিয়া দেয়। ক্যায়া আজিব বাৎ! পৃথিবী যদি চন্দ্রকে ঢাকিয়াই দিল তাহা হইলে কী দুনিয়ার তাবৎ মানুষ যাইয়া চন্দ্রে পতিত হইবে না?

যাহা হইক, আপাতত এইটুক লিখিয়াই কলম থামাইলাম; সময় হইয়া গিয়াছে, গিয়া চন্দ্রকে প্রহরা দিতে হইবে। সেই সাথে মূল রহস্য কি তাহও জানিয়া ও দেখিয়া আসি।