বিদ্যালোভে বিদ্যানাশে, বিদ্যা নাহি লভে

পূর্বে ভাবিতাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ করিবার উদ্যেশ্য বুঝিবা জ্ঞান অর্জন, বিদ্যালাভ ও বিশ্বকে উদার নয়নে দেখিবার পথনির্দেশ লাভ – ইহাতে ঐহিক বা পারত্রিক লাভ মুখ্য নহে বরং আত্মিক উন্নয়ন সাধন ও মানসিক সৌকর্য অর্জন-ই বিধেয় । কিন্তু আজ জানিলাম ভিন্নতর; ছেলেমেয়ে মিলিয়া বিগলিত চিত্তে হরদম ঘুরিয়া বেড়ানো, শহরের আনাচে কানাচে, গলিতে ঘুপচিতে, রাস্তায় ময়দানে যখন যেখানে সম্ভব উদ্যাম আনন্দে মাতিয়া ওঠাই যেনো বিশ্ববিদ্যালয়ের মোকশো । আরও জানিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ করিয়াই সাফল্যের দুয়ারে পৌঁছানো যায়, যে সাফল্যের অর্থ দামি গাড়ি ক্রয়। আসলেই আজ মনে হইতেছে বিশ্ববিদ্যালয় হইলো গাড়ি-বাড়ি-নারী লাভের শষ্যক্ষেত্র, নিতান্তই মূল্যহীন কিছু জ্ঞানের জন্য আর যাই হৌক কেহ তো পয়সা খরচ করিতে আসিবে না ।

এককালে জানিতাম, অক্সফোর্ড, কেম্ব্রিজ এসকল নামীদামী পাঠকেন্দ্রে বিদ্যার্থীর সমাগম হতো; সেসব বিদ্যার্থীর মোকশো ছিলো না বাড়ি গাড়ি অর্জন; ছিলোনা বাহারি জীবনের স্বপ্ন । তাহারা জানিত বিশ্ববিদ্যালয় মানে হইলো অনেকটা খাটুনি আর কতোটুকু কষ্টের মাধ্যমে জ্ঞানগুরুর দেখানো পথে চলিতে শেখা । সেসকল বিশ্ববিদ্যালয়ের দেখাদেখি দুনিয়ার তাবৎ স্থানে একসময় নানা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়িয়া ওঠিতে থাকে । আমাদিগের এই বঙ্গদেশেও সরকারি নানান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপনা চলে । কালের আবর্তে সেসবের পাঠের ধারার পরিবর্তন হয় । প্রাথমিক ভাবে আসলেই ছাত্রছাত্রীগণ পার্থিব মোহে নয় আত্মিক বিকাশেই পড়িতে যাইতো; ঠিক চাকরির মোহে নহে । কিন্তু কালে কালে বিবর্তন হয় মানুষের; পরিবর্তন ঘটে বিদ্যার্থীর ।

সময়ের আবর্তে চাকুরির খোঁজ পাইতে গিয়া সকলেই দেখিতে থাকে চাকুরির জন্য দরকার হইতেছে উচ্চ ডিগ্রী । বাঙালি পিতামাতা স্বপ্ন দেখিতে শিখে তাহাদের সন্তান হইবে ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার; কিংবা সরকারি বড় চাকুরে, জজ-মেজিস্ট্রেট-সচিব নয়তো উকিল-ব্যারিস্টার । শিক্ষার্জনের সার্টিফিকেট স্বভাবতই অনেকেরই চাকরির নিয়ামক হইয়া উঠে । গুরুজনের চোক্ষে দ্রষ্টিত স্বপ্ন নিজ আঁখিপটে লালন করিয়া হাজারো বাঙালির পুত্রকণ্যা ভর্তি হইতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে, ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, মেডিকেল কলেজ সমূহে । সেই ১৯৭০ এর দশকে ঝাঁকে ঝাঁকে বাঙালি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হইতো মৌলিক বিজ্ঞান শাখায়; তাহাদের থেকে অনেকেই হইয়াছে বড় আমলা, দেশের মাথা হর্তাকর্তা । দিনে দিনে কমিতে থাকে টাকাপয়সার মূল্য, বাড়িতে থাকে জীবনযাপনের ব্যায়; সরকারি চাকুরির চেয়ে কখনো বেসরকারি চাকরি ও ইঞ্জিনিয়ারিং কিবা ডাক্তারি অধিক লোভনীয় হইতে থাকে; ঝাঁকে ঝাঁক দেশসেরা বাংলাদেশি সুসন্তান সকল বুয়েট/ঢাকা মেডিকেলে পাঠার্জনের চেষ্টায় নিয়ত রীতিমত আদা জল খাইয়া প্রচেষ্টা চালাইতে থাকে; কহিতে লজ্জা নাই আমিও করিয়াছি সে চেষ্টা । কিন্তু তখনো, লোকে কষ্মিনকালেও ভাবিতে পারে নাই যে ৪-৫ বছরের স্নাতক কোর্সে হাসিয়ে খেলিয়া পার করিয়া দেওয়া যাইবে আর নিয়মিত বেতনাদি পরিশোধ করিলেই সময় শেষে হাতে সনদপত্র ধরাইয়া দিবে! স্কুলে-কলেজে তখনো সকলে পড়িতো, শিখিতো — নিগূঢ় তত্ত্ব জানিতে বুঝিতে চেষ্টা তপস্যা করিতো । সেই চেষ্টার ফলশ্রুতিতে এসএসসি, এইচএসসি বিবিধ পরীক্ষা শেষে ভর্তিপরীক্ষা’র যুদ্ধ জয় করে নিজের বুদ্ধির প্রাখর্য ও আত্মিক উন্নয়ন সাধনের অভিলাষ দেখাইয়াই লোকসকল পড়িতে আসিতো । বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকিয়া শিক্ষকদিগের প্রবল চাপে পিষ্ট হইয়া বিদ্যালাভের চেষ্টা করিতেই হইতো । রাজনীতি, সেশনজট, মারামারি এসকলে পতিত হইয়া যদিও পাঠের পরিবেশ দিনে দিনে লাটে উঠিতে থাকে; তবুও বিশ্ববিদ্যালয় মানে যে পড়িবার স্থান, মানসিক সৌকর্য অর্জনের পাথেয় তা সকলেই জানিত ও মানিত । তাই ৪-৫ বৎসরের স্নাতক পাঠ বেশি সময় লাগাইয়া শেষ করিলেও এসকল শিক্ষার্থী কিছু না কিছু বৃহত্তর জীবনের খোঁজ শিখিয়াই বাহির হইতে পারিতো ।

সময়ের বিবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ আজ তাহাদের মূল উদ্দেশ্য হইতে বহুদূর চলিয়া আসিয়াছে । বিশেষ, রাজধানী শহরের নানান পাড়া-মহল্লায় গজাইয়া উঠা অর্ধশতাধিক নানাবিধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনেকেই কেবলই “টাকা দাও, মজা লও, সনদ লও” মন্ত্রে মন্দ্রিত হইয়া নিশিদিন শিক্ষাউদ্ধার করিতেছে । যেসকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তব্য হইতো নূতন-নবীন কিশোর-তরুণের চোখের ধাঁধা দূর করিয়া, বিষম খাওয়া দুনিয়ার ভেল্কি উন্মোচন করিয়া খোলা নয়নে, উন্মুক্ত মননে জগৎ দেখিবার ও পথ চলিবার নির্দেশ করিবার তাহারাই বরঞ্চ আজিকে এইসকল কচিকাঁচার চোখে রঙিন চশমা পড়াইয়া দেখাইতেছে ধূম্রজালের আভরণে ঢাকা চাকচিক্যমণ্ডিত অলীক জগতের মোহমায়া স্বপ্ন; এসকল তরুণ তরুণীর নেত্রপল্লবে নাচিতে থাকে দুর্লভ সবুজ ফেইরির উদ্বেলিত স্বপ্নসাধ, বক্ষ তাহাদের ভরপুর যেন কবি নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার যত জগজ্জয়ী বীরসুলভ তারুণ্যের আস্থায় উপচাইয়া পড়া ভরপুর মদ…হরদম । তাইতো আজিকে পত্রপত্রিকা খুলিলেই নয়নসমুখে আপতিত হয় সেইরূপ কতিপয় বিদ্যাবিপনীর বিজ্ঞাপন যাহাতে বলা হয়: (আমার নিকট তাহাদের বিজ্ঞাপন শ্রুত হয় ফার্মগেট সহ শহরের-গঞ্জের, হাট-বাজারের হকারদিগের বিজ্ঞাপনের ন্যায়, তাই তাহাদের ভাষাতেই উদ্ধৃত করিলাম)

  • এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িলে আপনি জানিতে পারিবেন কিভাবে বাসে ঝুলিয়া রাস্তার ঝকঝকে গাড়ি দেখিতে দেখিতে সেই গাড়ি কিনিবার স্বপ্ন জাগে ও কিরূপে সে স্বপ্ন পূরন করিতে হয়
  • এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িলে আপনি আরও পাইবেন কতিপয় উদ্ধতযৌবনা নারীসহশিক্ষার্থীনি ও আকর্ষণীয় একঝাঁক হ্যান্ডসাম সুপুরষ সহপাঠী
  • এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িলে আপনি সুন্দর সুন্দরী নানানো আত্মাবন্ধু পাইবেন যাহাদিগের সহিৎ নগরের আনাচে কানাচে একসাথে দিবানিশি যাপন করিতে পারিবেন
  • এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িলে আপনি নার্ডদর্শন বেচারা ছেলে হইতে বিবর্তিত হইয়া পরিণত হইবেন সুদর্শন তরুণীর স্বপ্নপুরুষে

এইরূপ নানাবিধ বিজ্ঞাপনই আজিকে চোখে ভাসিতে থাকে দিকে দিকে!

আজ বুঝিলাম, বিশ্ববিদ্যালয় মানে নয় “জ্ঞানের ভারে ভারিক্কী চালে আনত নয়নে কিছু নবতর বিশাল নির্মানের ক্ষীণ প্রত্যাশা লইয়া হাড়ভাঙা খাটুনি অন্তে বিদ্যাপাঠ শেষে দুরুদুরু বুকে সংসারের মাঝে বাহির হওয়া” বরং বিশ্ববিদ্যালয় মানে হইতেছে, “সদাউচ্ছল উদ্ধত বক্ষে আস্থার আগ্নেয়গিরি হইয়া বাঁধভাঙা আয়েশী জীবনযাপন শেষে আরও আয়েশী অলীক স্বর্গলাভের মদিরা স্বপ্নে বিভোর হওয়া”।

জয় গুরু দম বাবা

বিঃদ্রঃ, [১], [২], [৩] এইসকল বিজ্ঞাপনের সহিৎ এই রচনার কোনরূপ সংযোগ নাই; তবে এই বিশেষ বিজ্ঞাপনের সহিৎ থাকিলেও থাকিতে পারে ।

এই রচনাটি কুয়েট-এর প্রকাশমাধ্যম কুয়েট লাইভ এর জন্য লিখিত ও একই শিরোনামে প্রকাশিত

Published by

nafSadh

I study theory and applications of computing sciences.

5 thoughts on “বিদ্যালোভে বিদ্যানাশে, বিদ্যা নাহি লভে”

    1. 🙂
      কি যে যথার্থ আর কি যে অনর্থ আজিকাল তাহা বুঝাই বড় দায় 😦

      Like

  1. এহেন সাধুবাচ্য স্বাদু কোনো অংশেই নহে, গিলিতে কষ্টবরণ করিতে হইয়াছে বহু। তবে উদ্দেশ্যলোভে উদ্দেশ্যনাশে, উদ্দেশ্য নাহি লভে। 😛 😛 😛

    Like

    1. আহাঃ, কি কহিলা বৎস, বাঁকল যে মোর ছিঁড়িয়া গেলো 😦

      Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s