বাস ভাড়া লইয়া

একদা এক রাজ্যে কতিপয় মনুষ্য ‘রাজনগর’ নামীয় নগরে বসবাস করিত । নগরীখানা অতিশয় খাশা এবং দেশের ব্যবসা-বানিজ্য, শিল্প কারখানা সকলই উক্ত নগরীতেই আসিয়া বাসা বাঁধিয়াছিল; রাজ্যের যাবতীয় সুযোগ সুবিধাও কেবল এই নগরীতে পাওয়া যাইত । নানাবিধ কারনে নগরের জনসংখ্যা প্রতিদিন বাড়িতে বাড়িতে নগরের সকল লোক উপচাইয়া পড়িতে লাগিল । এইরকম উপচাইয়া পড়া লোক–সকল প্রতিদিন ‘ঘোড়ায় চরিয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল’ এই পুঁথি পাঠ করিতে করিতে আপন গৃহ হইতে কর্মালয়েরর উদ্দেশ্যে রওনা করিত । কিছু লোক যাহাদিগের আপন মোটরবাহন রহিয়াছে তাহারা নিজ বাহনে আয়েশের সহিৎ যাত্রা করিত – আর যাহাদের সেইরূপ ব্যবস্থা নাই তাহাদের বাহন বিশালাকৃতির বাস । এইসকল বাসে পঞ্চাশ বসিতে পারিত এবং বসিবার মাঝের সরু স্থানে আর পঞ্চাশ-ষাট জন অতিশয় আমোদের সহিৎ গমনাগমন করিত । আমোদের উৎস হিসেবে তাহাদিগের জন্য ব্যবস্থা ছিল, শীতকালে বিশেষ উত্তাপ এবং গ্রীষ্মে যখন তখন বারিধারায় ভিজিয়া ও কর্দমাক্ত হইয়া দেশমাতৃকার স্বাদ লাভের দুর্লভ সুযোগ । এছাড়াও পিছন হইতে ধাক্কা, সামনে হইতে গুঁতো খাওয়ার সুযোগও প্রায়শঃ-ই হইয়া থাকে। প্রয়োজনে বিবিধ নারীপুরুষের বাহারি দস্তুর পোষাক পরিচ্ছদ ও বিবিধ ভাষণ শুনিয়াও অতিশয় আমোদ হইত। বাস ও মোটরবাহন যে বাহনেই যাত্রা করা হউক, গন্তব্য কুড়ি মিনিটের হইলে গন্তব্যে পৌঁছাইতে নিদেনপক্ষে এক ঘন্টা কুড়ি মিনিট লাগিত । ভাগ্য এত সুপ্রসন্ন না হইলে সে সময় দাড়াইতে পারে দুই ঘন্টা বা তাহরও অধিক।

এইসকল সুযোগ সুবিধার মধ্যে হঠাৎ করিয়া বাসের মালিকগণ বাস ভাড়া শতকরা ২০-৪০ হারে বাড়াইয়া দিলেন। কতিপয় ছিদ্রান্বেষী ব্যক্তি ইহাকে অপকর্ম হিসেবে চিহ্নিত করিলেও আসলে ইহাতে প্রভূত উত্তম উদ্দেশ্য রহিয়াছে।
প্রথমত, জনগণ বহুকাল যাবৎ দাবী করিয়া আসিয়াছিল যে বাসের ও যাতায়ত ব্যবস্থার উন্নতি করা হউক। আমরা জানি ভালো ও উন্নত বস্তু মাত্রেই তাহার মূল্য কিংবা ভাড়া বেশি হইবেই। সুতরাং যাহার ভাড়া অধিক তাহার গুণগত মান উন্নত। বাস ভাড়া বাড়াইয়া তাই সকল যাত্রীকেই পূর্বের বাসেই আরও উন্নত সুযোগ ও সেবা পাবার ব্যবস্থা করা হইল।
দ্বিতীয়ত, বাস ভাড়া বাড়াইবার ফলে কিছু লোকের জন্য বাসের ভাড়া অতি উচ্চ হইবে বিধায় তাহারা বাসে উঠিবে না, ফলে বাসে ভিড় কমিয়া যাইবে।
তৃতীয়ত, বাসের দুর্মূল্য হেতু অনেকেই বাসে না উঠিয়া হাঁটিয়া যাইবে। হণ্টন স্বাস্থ্যের জন্য অতি হিতকর ব্যায়াম এবং হণ্টনের দরূণ মনুষ্য দেহের প্রভূত উপকার হইবে। ফলত জাতীয় স্বাস্থ্যের উন্নতি হইবে।
চতুর্থত, বাসের ভাড়া বৃদ্ধিতে বাস মালিকগণের আয় বাড়িবে ফলতঃ রাজ্য অধিক কর আদায় করিবে ও সেই কর দিয়া প্রজাসকলের সুযোগ সুবিধা আরও বাড়াইয়া দিবে।

এত সকল সুফল থাকা স্বত্তেও বাসের ভাড়া বৃদ্ধির বিরোধিতা করিবার কি কারন থাকিতে পারে তাহা এই অধমের বোধগোম্য হইতেছে না 😉

গগণবিহারীর আকাশপি

একদা এক রাজ্যে বালুকাবেলা নামীয় শহরকে কেন্দ্র করিয়া এক বিশেষ ধরণের ব্যবসা গড়িয়া উঠিয়াছিল । এই ব্যবসা বিশ্বব্যাপিয়া তাহারা করিত এবং এরকম ব্যবসায়ী গোষ্ঠীও ছিল প্রচুর । তাহাদিগের মধ্যে বেশ নাম করিয়াছিল “মার্‌কশ্যপ”, “গুলতি” ও “মুখোচ্ছবি” নামীয় কতিপয় বেনিয়া গোষ্ঠী।

মার্‌কশ্যপ অতি দীর্ঘকাল ধরিয়া সকলের বাড়িঘর কেমনে চালনা (operate) করিবে তাহার জন্য সুবিধা করিয়া দিয়া আসিতেছিল, এছাড়াও তাহারা বিবিধ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, সংস্থা চালাইবার, অর্থাদির হিসাব রাখিবার, সুন্দরভাবে লিখিবার প্রদর্শন করাইবার জন্য বিবিধ উপকরণ তৈয়ার ও বিক্রয় করিয়া আসিয়াছিল । তাহার প্রায় সকল পণ্য অল্প বিস্তর মূল্যে জনতার নিকট বিক্রয় করিত । এসব করিয়া তাহারা যথেষ্ট নাম, যশ ও অর্থ কামায়াছিল।

গুলতি নামক এক যেই বেনিয়াগোষ্ঠী ছিল তাহাদিগের মূল কর্ম ছিল খোঁজাখুঁজি করিয়া দেওয়া । কাহার দোকানে কি রহিয়াছে, কোন স্থানে গেলে কি পাওয়া যাইবে – এইসব তথ্য যেমন গুলতি সবাইকে জানাইত তেমনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন কথা ও তথ্য খুঁজিয়া পাইতেও তাহারা সাহায্য করিত । তাহাদিগের আর ব্যবসা ছিল বিজ্ঞাপন প্রদান ও পুস্তক বিক্রয় । এর ছাড়া তাহারা সবার মধ্যে যোগাযোগ করাইবার বিভিন্ন ব্যবস্থাও করিত।

আর ছিল মুখোচ্ছবি । মার্‌কশ্যপের ও গুলতির চাইতেও অনেক অল্প বয়সের বেনিয়া গোষ্ঠী মুখোচ্ছবি — তাহাদিগের মূল ব্যবসা হইল লোকজনের বন্ধুসকলের হিসাব রাখা। কোন বন্ধু কি করিতেছে, কাহার কি অবস্থা ইত্যাদি মুখোচ্ছবি ব্যবহার করিয়া একে অপরকে জানাইতে পারিত — ছবি, লেখা ইত্যাদি প্রকাশ করিয়া, চিঠিপত্রাদি পাঠাইয়া।

মার্‌কশ্যপ, গুলতি ইহাদেরও পণ্য রহিয়াছে চিঠিপত্র পাঠাইবার, আলোচনা করিবার ইত্যাদি বিবিধ প্রকারের — একের ব্যবসার উন্নতি তাই কখনোবা অপরের ব্যবসার ক্ষতি করিত।

এইরূপ কতিপয় বেনিয়া গোষ্ঠীর বাহিরেও ছিল অনেক ছোট বড় বেনিয়া – যাহারা নানান রকম পণ্য সামগ্রী বানাইয়া প্রভূত নাম কামইতো । কিন্তু অবস্থা এমন হইয়াছিল যে, কিছুকাল অতিবাহিত হইলেই বৃহৎ বণিকগণ অপেক্ষাকৃত ছোট ব্যবসাসকল কিনিয়া লইয়া নিজ নিজ ব্যবসার প্রবৃদ্ধি ঘটাইতো।
এইরূপ আরো একবার ঘটিল যখন, গগণবিহারী সাহেব তাহার বিখ্যাত “আকাশপি” নামক ব্যবসাখানা বিক্রয় করিয়া দিতে উদ্যত হইলো।

গগণবিহারী সাহেবের আকাশপি একখানা অতি জনপ্রিয় বস্তু; ইহাতে নানাকিছু করা সম্ভব হইয়া থাকে, যেমন দূরের কাহারো সহিৎ কথা বলা, তাৎক্ষণিক পত্রাদি প্রেরণ এমনকি বহুদূরে যে বা যাহারা বসিয়া রহিয়াছে তাহাদিগের দর্শন লাভও সম্ভবপর হইয়াছে । অকস্মাত গগণবিহারী সাহেব যেইক্ষণে আকশপি বিক্রয় করিতে চাহিল তৎক্ষণাত আসিয়াই তাহা কিনিতে চাহিল দুর্দান্ত প্রতাপশালী গুল্‌তি – বিবিধজনের ব্যবসা কিনিয়া লওয়া যাহার বিশেষ শখ এবং মুখোচ্ছবি – সর্বমানবেরে একই সূত্রে বাঁধিয়া যোগাযোগ করাইয়া দেওয়া যাহার আপ্তবাক্য । এই দুইজনেই চারি নিযুত আস্‌রফি করিয়া ক্রয়মূল্য কহিয়া কিনিবার চেষ্টা চালাইতেছিল । হঠাৎ করিয়াই মার্‌কশ্যপ ঘটনাস্থলে আসিল এবং ভাবিয়া দেখিল যে তাহারা যদি আকাশপি নামক জাদুকরি বস্তু পায় তাহা হইলে মার্‌কশ্যপের বিশেষ উপকার হয় । যেমন, তাহাদিগের ‘জীবন্ত’ নামীয় যে বিশেষ সেবা রহিয়াছে এবং বনেদিগোষ্ঠিদিগকে তাহার যেসব পণ্যসেবা দিয়া থাকে, তাহার সহিৎ এই আকাশপির গুণাগুণ জুড়িয়া দিলে বেশ হয় । ইহা ছাড়া মার্‌কশ্যপের তৈয়ারি খেলিবার যন্ত্র গুননবাক্স ও নাতালের সহিৎ আকাশপি লাগাইয়া দিলে এইসকল পণ্যের ক্রেতাসংখ্যা বহুগুণ বাড়িবে । তাহাদিগের হাতে বহন করা যায় এমন কথা বলিবার যন্ত্র ‘বহমান জানালা’ তেও এই সুবিধা বিশেষ আকর্ষণ আনিবে । সুতরাং মার্‌কশ্যপ অতি উচ্চমূল্য – সাড়ে আষ্ট নিযুত আস্‌রফি দিয়া আকাশপি কিনিয়া লইলো।

অবশেষে দেখা যাইতেছে, কিনিতে না পারিলেও লাভ মুখোচ্ছবি’র-ও হইতেছে । মার্‌কশ্যপ মুখোচ্ছবি-কে বিশেষ স্নেহের দৃষ্টিতে দেখিয়া থাকে এবং তাহারা কারবারিতে অংশীদারও বটে । ফলতঃ দেখা যাইবে যে মুখোচ্ছবি-ও গগণবিহারীর আকাশপি হইতে সুবিধা প্রাপ্ত হইবে।

যাহা হাউক এই বালুকাবেলা নগরের কান্ডকীর্তী বুঝা বড়ই দায় । কি হইতে যে কি হয় আমাদিগের ন্যায় সাধারণ মানুষ যাহারা – তাহাদিগের নাতিদীর্ঘ এন্টিনায় তাহা স্পর্শ করিতে অক্ষম॥

বিঃদ্রঃ এই গল্পের সকল চরিত্র ও স্থান কাল্পনিক; বিশেষ করিয়া আকাশপি, মার্‌কশ্যপ, গুলতি, মুখোচ্ছবি কোনক্রমেই Skype, Microsoft, Google বা Facebook নহে, বালুকাবেলা-ও সিলিকন ভ্যালী নহে। কেহ কষ্ট কল্পনা করিয়া বাস্তব জগতের কোন কিছুর সহিৎ মিল বা সম্পর্ক খুঁজিয়া পাইলে সর্ব-দোষ তাহার

শুরুর কথা

প্রথমেই শিরোনামখানা এইরূপ দিবার সার্থকতা আলোচনা করিঃ
ইতঃপূর্বে আমি এই খেরোখাতায় প্রাককথন লিখিয়া সাধুবচন রচিবার প্রয়াসের প্রেক্ষাপটের কথা কিছু বলিয়াছিলাম, আজিকে আরও কিছু বলিবার সাধ জাগিল, সবই প্রেক্ষাপটের কথন নয়, মনের মধ্যে যাহা আসিবে তাহাই কহিব। এবম্বিধ কারণেই শিরোনাম এমতি।

এক্ষণে সাধুবচনের নামের অর্থ লইয়া আলোকপাত করা যাক; আমি শব্দ লইয়া মজা করিতে পছন্দ করি তাই এই খেরোখাতার নাম করিয়াছি দ্ব্যর্থবোধক । সাধুবচনের দুই অর্থ হইতে পারে । সাধারণ সন্ধি সমাসে হইতে পারে, সাধু’র (কহিত) বচন – ইহা এই সাধুবচনের অর্থ নহে – সেইরূপ হইবার কোন কারনও নাই, আমি সাধুজন নহি । তাহা হইলে হইতে পারে, “সাধু ভাষায় রচিত বচন” – ইহা সত্য বটে, আমি এইখানে সাধুভাষাতেই রচিব বটে; তবে আমার বন্ধুপ্রবর ও সহকর্মী শাওন আরেফিন যেরূপ আশঙ্কা বা আশা করিয়াছেন যে, “এই খেরোপাতাটি বিলুপ্তমান শ্লোক সংরক্ষনে অগ্রনী ভূমিকা পালন করিবে। উদাহরণস্বরূপঃ মীনক্ষোভাকুল কুবলয়(!) তথাঃ মাছের তাঁড়নে যে পদ্ম কাঁপিতেছে।” — সেইরূপ হইবার কারন নাই । বরঞ্চ সাধুবচন-এ সাধুভাষার স্বাদু রূপ লইয়া সহজবোধ্য ও সর্বজনবোধ্য করিয়াই বঙ্গভাষায় মনোভাব প্রকাশ করিব । সংস্কৃত সন্ধি-সমাসের ভারে কুঁজো সাধুভাষা প্রকৃত বাংলা নয়; সংস্কৃতের জুজু সাধুভাষার উপর সিন্দাবাদের ভূতের ন্যায় চড়িয়া বসাতেই সংস্কৃতের ন্যায় সাধুভাষাও অপ্রচলিত হইয়া উঠিয়াছে ।
সাধুবচন নামের অর্থ এইরূপ কহিলেও অসত্য হইবে না যে, “সাধএর চ্চারিত বচন” । সাধুবচনে আমিই লেখিতেছি এবং আমার নাম সাধ-ই বটে । এইসকল তথ্য দিতেছি, কারন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যেইরূপ করিতাম, সেইরূপ যদি কাহারো “সাধুবচন” খেরোখাতার নামকরণের সার্থকতা নিরূপণের ইচ্ছা জাগে (কষ্টকল্পনা করিতেছি, আসলে আমি নিজেই তো সার্থকতা নিরূপনে ব্যতিব্যস্ত রহিয়াছি) তাহা হইলে সে কিছু রসদ এইখান হইতে পাইতে পারে।

অনেকেই প্রশ্ন করিবে “কি লইয়া লিখিতে বসিয়াছি?” – কারন আমাদিগের অভ্যাস এইরূপ যে কেহ কোন কিছু কহিতে আসিলে, বিশেষ করিয়া এইরূপ আঁটোসাঁটো বাঁধিয়া ওয়েবমাধ্যমে গোলোযোগ করিয়া টঙে চড়িবার আয়োজন করিলে প্রশ্ন তো করিতেই পারে, প্রশ্ন করাই সাজে । আসলে তো ইহা বিষয়হীন লিখিবার কথা – যাহা মনে চাহিবে তাহাই লেখিব; সাধের মনে যা সাধ হইবে তাহাই অত্রস্থানে সাধুভাষ্যে প্রকাশ পাইবে।
সাধুবচন নাম বটে, তাই বলিয়া কি ইহা সাধুলোকের কথা হইবে – আলবৎ নহে । ইহাতে সাধু অসাধু সকল আলোচনাই স্থান লইবে । বাংলা সাহিত্যে বিবিধকালে নানান মহান লেখক লিখিয়াছেন – যাহাদিগের রচনা কালের পুরাণ হইয়া রহিয়া গিয়াছে, বহিয়া যাইতেছে ভবিষ্যতের দিকে ক্লাসিক রূপে । ‘ক্লাসিক’ বাংলা কেহ করেন ‘চিরন্তন’, কেহ বা কহেন ‘ধ্রুপদী’ (<ধ্রুবপদী – ধ্রুব পদ যাহার) । এইসব ধ্রুপদী চিরন্তন সাহিত্য লইয়া কচিৎ সম্যক আলোচনা করিব – অর্থাৎ কি না সমালোচনা করিব । আধুনিক কালের লেখা লইয়াও করিব । আবার বর্তমান কালে আমাদিগের আশেপাশে যাহা ঘটিয়া যাইতেছে তাহা লইয়াও লেখিব । আমার এই খেরোখাতার এক অনুপ্রেরণা হইল আমারই বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগে অধ্যয়নরত অনুজপ্রতীম সতীর্থ ‘সদানন্দ’ খান মোহাম্মদ ইরতেজা ও তাহার ওয়েবব্লগ ঘাসফড়িং এর স্বপ্ন – যদস্থলে সে বিভিন্ন বিষয়ে অতিশয় প্রীতিপ্রদ উপায়ে বিবিধ বিষয়ে সুন্দর আলোচনা করিয়া থাকে । তাহার ন্যায় আমারও কখনো সাম্প্রতিক বিষয় লইয়া লিখিতে সাধ হয়, যথেষ্ট সুযোগ না হওয়ায় পূর্বে লেখা হইয়া উঠে নাই, আশা করি পরবর্তীতে হইবে ।

রচনার বিষয়বস্তু যেরূপ হইতে পারে বাঙালি, বাঙালিয়ানা, বাংলা ভাষা সেইরূপ হইতে পারে বিবিধ বঙ্গীয় ও বৈশ্বিক সাহিত্য, নাট্য, সংস্কৃতি, চলচিত্র, চালচিত্র; হইতে পারে প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, ধর্মের কথা কিংবা ধর্মতত্ত্ব, হইতে পারে ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, নৃবিদ্যা কিংবা সম্পূর্ণ নার্ড (nerd) গিক (geek) দের ন্যায় বিষয়াদি । পাঠে স্বাদ পাইলে বা ভালো লাগিলে প্রকাশ্যে বলিবেন, মন্দ লাগিলে পশ্চাতে গালাইবেন – আপত্তি করিব না :-৯

প্রবন্ধ যেইরূপ হইতে পারে লেখার ধরন তেমনি রম্য কিংবা গল্প-ও গদ্যের অপর ধারা; আমি তো সেইরূপ-ও লেখিব; আপনারা যতই উচ্চবাচ্য করেন আমি কহিব, বরং আমার সকল রচনাই অল্প-বিস্তর রম্যরসে জারিত করিতে সচেষ্ট হইব । যদ্যপি শ্রী প্রমথ চৌধুরী, শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মা (বিদ্যাসাগর নামেই যিনি অধিক পরিচিত), সৈয়দ মুজতবা আলী, আব্‌দুশ শাকুর প্রমুখের ন্যায় উইট বা রসবোধ আমার নাই (উপরন্তু তাহাদিগের সহিৎ তুলনা করিবার চেষ্টা যেরূপ পাপকর্ম হইলো তাহাও অমোচনীয়) – তথাপি আমি কিছুটা উইট রাখিবার চেষ্টা তো করিতেই পারি; মহান লেখকের দ্বারা অনুপ্রাণিত হওয়া আর যাহা হউক দূষণীয় নহে!

রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গ

বঙ্গভূমিতে অল্পবিস্তর প্রতিভা ও খ্যাতি সম্পন্ন ব্যক্তি, যাহার বৈশ্বিক পরিচিতি রহিয়াছে এমন উদাহরণ সামান্যই; কিন্তু যাহাই রহিয়াছে তাহা অতি উচ্চমানের ও গৌরবের । এমনই এক মহান বঙ্গসন্তান, সাহিত্যাকাশে রবিরূপ প্রোজ্জ্বল শ্রী শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – বিশ্বকবি হিসেবেই যাঁহার অধিক সুনাম তিনি বিশ্বদরবারে গীতাঞ্জলির প্রণেতা পোয়েট ট্যাগোর (Poet Tagor) হিসেবেই সবিশেষ পরিচিত । কিন্তু শুধু ‘গীতাঞ্জলি’ কিংবা কাব্যই তাঁহার পরিচয়ের সর্বাংশ নহে, বরঞ্চ ইহা তাঁহার সৃষ্টিশীল ও মননশীল কর্মসমূহের একাংশ মাত্র।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহস্র গানের গীতিকার, অজস্র কাব্য তাঁহার রচিত যাহার উৎকৃষ্ঠ কিছু তিনি সন্নিহিত করিয়াছেন সঞ্চয়িতা‘য় । এই সঞ্চয়িতার আকারই এত বিশাল যে তাহা হস্তে লইয়া বিছানায় দেহ এলাইয়া দিয়া পাঠ করিবার উপক্রম নাহি । তাঁহার কাব্যের গুণ বড়ই উত্তম — তাহা সুপাঠ্য ও হৃদ্য কিন্তু সর্বদাই সহজবোধ্য নহে… বিশেষ করিয়া ‘সোনার তরী’ কাব্যখানি বুঝিবার জন্য যথেষ্ট ইলমের ও আলোচনার দাবি রাখে । কবি হিসেবে তিনি সফল সার্থক ও মহৎ, তাঁহার কাব্যপ্রতিভা লইয়া অধিক আলোচনার অবকাশ নাই । বাংলা কাব্যের যে ধারাকে বেগবান করিয়াছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত সেই ধারাকে তিনিই প্রতিষ্ঠা দিয়াছেন । তাঁহার রচিত গানই দুই দুইটি রাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গীত হইতেছে । এইটি যেমন তাঁহার জন্য বড় গৌরবের তেমনি আমাদিগের জন্যও এক পরম প্রাপ্তি । যদিওবা তাঁহার কিছুটা সংস্কৃতায়িত ভাবাপন্ন রূপে রচিত ‘জন গণ মন’ সঙ্গীতখানি অবাঙালির কণ্ঠে এমনই উচ্চারণ লইয়াছে যে তাহাকে বাংলা বলিয়া বোধ হয় না । বাংলাদেশেও ‘আমার সোনার বাংলা’ সর্বদা সঠিক স্বরলিপিতে গীত হয় নাই।

কবি ও কাব্য রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের বৃহৎ অংশ – তাঁর পরিচয় কবি হিসেবে । কিন্তু বস্তুত তাঁহার পরিচয় হওয়া উচিৎ সাহিত্যিক হিসেবে, সাহিত্যের সকল ধারাতেই তাঁহার সাবলীল বিচরণ । বিশেষ করিয়া ছোটগল্প   যেন তাঁহার কলমে বহিয়াই বাংলা সাহিত্যের জগতে প্রবেশ করিয়াছে । সাধারণত এইরূপই পরিলক্ষিত হয় যে, যে লেখক সাহিত্যের এক বিশেষ ধারার সূচনা করিতে প্রচেষ্ট হন সেই ধারা তাঁহার দ্বারাই পূর্ণতা লাভ করে না । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরে ছোটগল্প সেইরূপ হয় নাই; ছোটগল্পের স্বপ্রদত্ত সংজ্ঞা “শেষ হইয়াও হইলো না শেষ” – এর প্রকৃষ্ঠ প্রয়োগই তিনি করিয়াছেন । তিনি সর্বপ্রকার উদাহরণ দিয়া দেখাইয়া দিয়াছেন সাহিত্যের এই বিশেষ প্রকরণ কিরূপ হইলে উত্তম হয় । তাঁহার ছোট গল্পের মধ্যে সকলের অবশ্য পাঠ্য করা হইয়াছে (মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করিয়া) ছুটি ও হৈমন্তী, ইহা ছাড়াও তাঁহার গল্পগুচ্ছতে সন্নিবেশিত ইচ্ছাপূরণ, বলাই, রাজটিকা, কবুলিওয়ালা ইত্যাদি বস্তুতই বাংলা সাহিত্যের উৎকৃষ্ঠ সৃষ্টি; বিশেষ করিয়া ‘জীবিত ও মৃত’ গল্পের সমাপ্তির বাক্য, “কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই” — সত্যিই আমার নিকট অসাধারণ বলিয়া প্রতিভাত হইয়াছে।

নাটক ও উপন্যাসেও তিনি তাঁর দক্ষ লেখনীর ছাপ রাখিয়াছেন । ‘রক্তকরবী’ তাঁহার সর্বাধিক পরিচিত নাট্য আর “শেষের কবিতা” তাঁহার সর্বাধিক পঠিত উপন্যাস । তবে ছোটগল্প রচনায় তিনি যে সার্থকতা দেখিয়েছেন তাঁহার উপন্যাসে ঠিক ততটুকু পরিলক্ষিত হয় নাই । আবার প্রবন্ধ প্রণয়নে, চিঠি লেখায় ও বক্তব্য প্রদানে তিনি অত্যন্ত কুশলী ও সফল একজন শিল্পী । সেইযুগে খেরোখাতা বা ব্লগ লেখিবার চল ছিল না, উপায়ও ছিল না বটে । বোধ করি সেই সুযোগ ঘটিলে তিনি ব্লগার হিসেবেও অতিশয় নাম কামাইতে পাড়িতেন; অবশ্য সেক্ষেত্রে কিছু দুর্জন তাঁহার দুর্নাম করিতেও হয়তোবা ছাড়িতেন না । তিনি তো যথার্থই বলিয়াছিলেন, “রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি”।

এই তো গেল তাঁহার সাহিত্যিক রূপ, জন্মের সার্ধশত (১৫০তম) বার্ষিকীতে প্রকাশ্য শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের আবশ্যক অংশ । এছাড়া তাঁহার সম্পর্কে আরও কিছু লিখিবার ইচ্ছা লইয়া আগাইয়া যাইবো। এপ্রসঙ্গে উল্লেখ করিব যে, সাহিত্যচর্চা ছাড়া তিনি চিত্রাঙ্কন, সঙ্গীত সাধনা ও নানাবিধ শিল্পচর্চাও করিতেন । তাঁহার চিত্রাঙ্কনের অসংখ্য নমুনা বিদ্যমান – কলমের পাশাপাশি তুলির আঁচড়ে মনের ভাব প্রকাশ করিতে তিনি ভালো বাসিতেন । তাঁহার নানাবিধ সৃষ্টিশীলতা সবিশেষ আলোচনা এই সীমাবদ্ধ পরিসরে করা সম্ভব হইবে না বিধায় অনেক প্রসঙ্গই বাদ দিয়া যাইতেছি।

এইমাত্র, রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক পরিচয়ের কিছু আলোচনা করিবার প্রয়াস লইবো । সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলিকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুরবাড়ির সন্তান, কলকাতার পত্তন ও উত্থানের সহিত-ই পিরালী বামুন খ্যাত এই ঠাকুর বংশের সম্পর্ক । রবিঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন অভিজাত ও তুখোড় বণিক, আপন দক্ষতায় তিনি ছিলেন কলকাতা ও সর্ববঙ্গের শীর্ষ অভিজাত – জাহাজ ব্যবসার মাধ্যমে ও ব্রিটিশ কোম্পানীর সহিত ব্যবসায় তিনি সর্বভারতের শ্রেষ্ঠ ধনিক হিসেবে আবির্ভূত হন । দ্বারকানাথ ঠাকুর ইউরোপে গিয়ে বিভিন্ন রাজন্যদিগকে যেরূপ উপহার প্রদান করেন ও যেইরূপ আভিজাত্যের নমুনা প্রদর্শন করেন তাহা সকলকেই চমকিত করিয়া তুলে । পক্ষান্তের রবিঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন পার্থিব মোহমুক্ত পুরুষ; জমিদারি ও ব্যবসায় তার ছিল ঔদাসিন্য; পিতার বন্ধু রাজা রামমোহন রায়ের প্রবর্তিত ব্রাহ্মসমাজের সদস্য হিসেবে ও পরবর্তীতে সমাজের অধ্যক্ষ হিসেবে পারত্রিক ও ঐহিক মুক্তির উপায় হিসেবে একেশ্বরবাদী বর্ণপ্রথামুক্ত ব্রাহ্ম ধর্ম প্রবর্তন করেন তিনি । পিতা ও পিতামহ দুইজনের চরিত্র বৈপরীত্যে পরিপূর্ণ বিধায়ই সম্ভবত বীন্দ্রনাথ স্বয়ং নিজস্ব ভিন্নধরণের চারিত্রিক গুণাবলী ও আপন ধ্যান-ধারণার অধিকারী ছিলেন।

জমিদার হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রজাদরদী । কী প্রকারে সকলের ভালো হইতে পারে তাহার চিন্তাই তিনি করিতেন । নিজ জমিদারী এলাকায় কৃষকদিগের সুবিধার জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেরন কৃষি ব্যাংক । সুদ ও জামানত ব্যাতিরেকেই তিনি আপন প্রজাদিগকে ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করিতেন । তাঁহার ন্যায় অন্যান্য জমিদারসমূহ এরূপ কল্যানী ভূমিকায় আবর্তিত হইলে তৎকালে দেশের প্রভুত উন্নতি হইতো বলিয়াই বোধ হয়। তাঁহার এই ব্যাংকের ন্যায় কল্যানীয় আধুনিক ক্ষুদ্রঋণ কিংবা কষিঋণ প্রতিষ্ঠানসমূহ হইতে পারে নাই। দেশের কৃষিখাতের উন্নতিতে তিনি কৃষিশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন অনুধাবন করে তদানুজায়ী উদ্যোগীও হন ।

প্রাতিষ্ঠানিক তেমন শিক্ষা গ্রহণে তেমন ইচ্ছুক না হইলেও ঠাকুরবাড়ির ঐতিহ্য মোতাবেক বিশদ শিক্ষার্জন তাঁহার হয় এবং তিনি বিলেতে আইন পাঠ করিতেও গিয়াছিলেন কিছুকালের জন্য । তিনি বাংলা ও সর্বভারতে সুশিক্ষার প্রসারের প্রয়োজন প্রখরভাবেই অনুভব করেন এবং তিনি শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন । এই বিশ্ববিদ্যালয় বাংলায় সুশিক্ষা বিস্তারে ও সর্বভারতীয় শিক্ষার উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে । ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ও বাঙালিত্বের বিকাশেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাব প্রকট।

রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব রাজনৈতিক বিশ্বাস ছিল এবং তদানীন্তন রাজনীতিতে তাহার প্রভাবও ছিল অনেক । বাঙালি ও ভারতীয় জাতীয়তাবোধের গঠনে তিনি ভূমিকা রাখেন । বিবিধ প্রসঙ্গে তিনি ব্রিটিশ রাজের সমালোচনা করিতেন । অমৃতসর হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে তিনি ব্রিটিশরাজদত্ত নাইটহুড খেতাব পরিত্যাগ করেন এবং এইজন্যই তাঁহার নামের পূর্বে স্যার শব্দখানি লিখিত হয় না । তিনি বঙ্গভঙ্গের সমালোচনা করেন আবার হিন্দুত্ববাদের তিনি সমর্থক ছিলেন না । তাঁহার রাজনৈতিক অবস্থান বোঝা তাই ছিল কিছুটা জটিলতাপূর্ণ।

বিবিধ কারনেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালির এক অমূল্য সম্পদ । তিনি প্রথম অ-ইউরোপীয় হিসেবে তিনি নোবেল পুরষ্কার পান । ড. অমর্ত্য সেন ও ড. ইউনূসের পূর্বে বহুকাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন একমাত্র বাঙালি নোবেল লরিয়েট।

রবীন্দ্রনাথ বাঙালিত্বের অহংকার – এই অহংকার আজ বানিজ্য হইয়া যাইতেছে । সার্ধ শতবার্ষিকীতে আসিয়া বাংলাদেশ-ভারত যৌথ জয়ন্তী উদযাপন হইলেও আজ উত্তারাধুনিক বাঙালিয়ানা দেখিলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অভিভূত হইতেন; খুবই আনন্দের বিষয় এই যে এইরূপ আদিখ্যেতা সমূহ তাঁহাকে দেখিতে হয় নাই । অনেক কাল ধরিয়েই রবীন্দ্র চর্চাকারীগণের মধ্যে অতি ভাবালুতা দেখা গেলেও অধিকাংশ রবীন্দ্রদোদ্ধা বাঙালির সঠিক রূপ দিয়া যাইতেছিলেন । কিন্তু আজিকে রবীন্দ্রনাথের প্রতি বাঙালির ভালোবাসাকে পুঁজি করিয়া ব্যবসা হইতেছে । আজকাল উদ্‌ভ্রান্ত উত্তরাধুনিক বাঙালি বালক বালিকার কন্ঠে রবিঠাকুরের প্রশংসাবাক্য ধ্বনিত হয় এই রূপে, “ওঃ! ট্যাগোর ইজ গ্রেট; হিজ গিঠান্‌জালি ইয অ্যাজ্‌ গুড অ্যাজ্‌ শেক্‌সপীয়র” । আজিকে রবীন্দ্রপ্রেমী বৈশ্বিক বাঙালি নতুনভাবে রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করিল এক ফ্যাশন শোতে যেখানে তাহারা আসিল পাশ্চাত্যের পোশাক পরিধান করিয়া । দুই একখান তাও ফিউশান পাঞ্জাবি ও শাড়ির ন্যায় দেখিতে পোশাক পড়িয়া তাঁহারা ‘ট্যাগোর’কে বিশ্বদরবারে তুলিয়া ধরিতে গিয়া নামাইয়া আনিলেন ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক অনেক বড় বিষয়, তাহার কৃতকর্মের সম্মাননা আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয় ‌— সেইরূপ সাধ্য নাই তাই সেই স্পর্ধাও নাই – তবে তাঁহার জন্মজয়ন্তীতে আজ পঁচিশে বৈশাখে কিছু লিখিয়া অন্তত নিজের কিছু মনোভাব প্রকাশের সাধ তো আছেই । তজ্জন্যই এইটুকু রচনা।

বাঙালি, বাংলা সাহিত্য, সাহিত্যিক এইসকল বিষয় লইয়া আরও লিখিবার আশা রাখি । তবে আজিকে কবিগুরু বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিস্ময়’ কবিতার কিছু অংশ উদ্ধৃত করিয়াই খোরোখাতার এই ভুক্তির সমাপ্তি টানিব:

বিশ্বজয়ী বীর
নিজেরে বিলুপ্ত করি শুধু কাহিনীর
বাক্যপ্রান্তে আছে ছায়াপ্রায় । 

… … …
… … …
… … …

ধ্বংসধারা মাঝে আজি আমার ললাট
পেল অরুণের টিকা আরো একদিন
নিদ্রাশেষে,
এই তো বিস্ময় অন্তহীন ।

… … …
… … …
… … …

জানি এ-দিনের মাঝে
কালের অদৃশ্য চক্র শব্দহীন বাজে ।

প্রাককথন

বঙ্গভাষা বা বাংলা ভাষা বাঙালির প্রাণের ভাষা — প্রায় তিরিশ কোটি বা ইহার চাইতেও অধিক সংখ্যক আদম-সন্তান বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিবিধ প্রান্তে প্রতিদিন প্রতিক্ষণে বঙ্গভাষায় কলরব করিয়া উঠে, ক্ষণে ক্ষণে মুখর হইয়া উঠে হৃদয়ের আকুল ভাব প্রকাশের তাড়নায় – বাংলায় কথা কইবার বাসনায় । বাংলা ভাষার ন্যায় সুন্দর ভাষা আর নাই; ইহার ন্যায় মনোহর নয় মানবের আর কোনো বুলি; ইহার মতন আপন নহে আর কাহারো বচন — বাংলা ভাষার রূপ যেরূপ স্বাদু বোধ হয় তেমন আর কাহারো আস্বাদ নয়। এই বাংলা ভাষার রহিয়াছে নানান রূপ, যেমন রহিয়াছে প্রাত্যহিক কথা কহিবার জন্য বিভিন্ন অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন প্রকরণ তেমনই লিখিবার ভাষাও সর্বদা একইরূপ নহে। লিখিবার দুই আদর্শ রূপ: সাধু ভাষা ও চলিত ভাষা; উভয় রূপই মান্য ও ব্যবহার্য ।

দুই-তিন শত বৎসর পূর্বে যৎকালে বাংলা ভাষায় নিয়মিত সাহিত্যচর্চা শুরু হইয়াছিল, যৎকালে বঙ্গের মানবসকল তাঁহাদের ভাষা লইয়া সম্যক প্রাতিষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করিয়া দেয়, তৎকালে সাধু ভাষাই হইয়া উঠে লেখালেখি করিবার মান ভাষা; এমনকি বিবিধ সভায় সাধুভাষায় বলিবার চল ছিল । তৎকালে অন্দরমহল ও বাহিরমহলের ভাষা ভিন্ন হইয়া পড়ে, লিখিবার ভাষা পরিশীলিত ও সুসজ্জিত হইয়া উঠে। তাই আমরা দেখিতে পাই তৎকালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ সকলেই সাধু ভাষাতেই লিখিয়াছেন । এই সময়ে কিছু কালের মধ্যে সংস্কৃত ভাষার জুজু আসিয়া বাংলার উপর ভর করিয়া বসে এবং বাংলাকে সংস্কৃতের কন্যা মনে করিয়া বহুসংখ্যক লেখক যথেচ্ছভাবে সংস্কৃত ভাষার সন্ধি-সমাস বহুল বিশাল ও দুর্বোধ্য শব্দসমূহ বাংলা ভাষায় ব্যবহার করিতে শুরু করিয়া দেন । এইরকম সময়েই প্রমথনাথ, প্যারীচাঁদ মিত্র প্রমুখ আধুনিক মনোভাব সম্পন্ন সাহিত্যিকের প্রচেষ্টায় কথ্য ভাষার-ই একটি পরিশীলিত রূপ লেখার ভাষা হিসেবেও ব্যবহারের চলন ঘটে এবং ধীরে ধীরে চলিতভাষা-ই সর্বজনগ্রাহ্য লিখিবার ও বলিবার মান ভাষা হইয়া দাঁড়ায় ।

চলিত ভাষার ব্যাপক প্রসার ও প্রচলনের পর বহুকাল অতিবাহিত হইয়াছে, ব্রহ্মপুত্র নদের বহু পানি গড়াইয়া যমুনায় পড়িয়াছে, নদীয়ার ভাষা বদলাইয়া গিয়াছে, ঢাকার লোকসংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়িয়া কোটি ছাড়াইয়াছে – তাহাও বহুকাল হইয়াছে । এতকিছু বদলাইয়াছে আর বাংলাভাষায় পরিবর্তন হয় নাই তাহা নয় । আজ সাধারণ ভাবেই বাংলাভাষার বেশ কিছু মান রূপ পরিলক্ষিত হইতেছে —

  • লিখিবার মান ভাষা অর্ধশতাধিক বৎসর কাল পূর্বের সেই চলিত ভাষাই রহিয়াছে
  • বন্ধুমহলে কহিবার ভাষা একরূপ
  • ব্যবসা-বানিজ্যে, কর্পোরেট কলচরে, আনুষ্ঠানিক প্রয়োজনে ভাষা আরেকরূপ
  • নাটকে-সিনেমায়ও ভাষা লইয়াছে ভিন্নতর রূপ
  • দলিলে দস্তাবেজে আজও অনেকস্থানেই সাধুাষার ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়

সাধুভাষার ব্যবহার কমিয়াছে বহুগুণ কিন্তু ইহা হারাইয়া যায় নাই; বিভিন্ন সময় বাংলার প্রকৃষ্ট সাহিত্যপাঠ করিতে গিয়া সাধুভাষার প্রতি আকৃষ্ট হইয়া উঠিতেছে অনেকেই । কখনোবা কেহ কেহ সাধুভাষাতেই নিজস্ব মনের কথা লিখিতরূপে ব্যক্ত করিয়া থাকে । সাধুভাষার একটি বড় গুণ ইহার অন্তর্নিহিত ছন্দ ও নিজস্ব আকর্শনীয় ভঙ্গিমা । সাধু ভাষাতে লিখিতে আনন্দলাভ হয়, ইহা পাঠে ভিন্নরকম রসাস্বাদন হয় । সাধুভাষা যেমন ভাবগম্ভীর ও অভিজাত তেমনি লঘু ও রম্য কথাও এইভাষার বলনে সহজভাবে প্রকাশযোগ্য হইয়া উঠে ।

বাংলাভাষায় প্রায়শই নিজ মনের ভাব লিখিবার ও প্রকাশ করিবার ইচ্ছা জাগিয়া উঠে আমার; আর সেক্ষেত্রে সাধুভাষার স্বাদ পাইতেও সাধ হয় । এই কারনেই সাধুভাষায় এই খেরোখাতার আবির্ভাব; এখানে আমি বিভিন্ন সময় সাধুভাষায় বিবিধ রচনা প্রকাশ করিবার চেষ্টা করিব । সকলকেই আমন্ত্রণ রইলো সাধুবচনের আঙ্গিনায় আসিয়া আমার রচনা পাঠ করিবার ও সম্ভব হইলে সাধু ভাষাতেই বিবিধ মন্তব্য করিবার ।