বিদ্যালোভে বিদ্যানাশে, বিদ্যা নাহি লভে

পূর্বে ভাবিতাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ করিবার উদ্যেশ্য বুঝিবা জ্ঞান অর্জন, বিদ্যালাভ ও বিশ্বকে উদার নয়নে দেখিবার পথনির্দেশ লাভ – ইহাতে ঐহিক বা পারত্রিক লাভ মুখ্য নহে বরং আত্মিক উন্নয়ন সাধন ও মানসিক সৌকর্য অর্জন-ই বিধেয় । কিন্তু আজ জানিলাম ভিন্নতর; ছেলেমেয়ে মিলিয়া বিগলিত চিত্তে হরদম ঘুরিয়া বেড়ানো, শহরের আনাচে কানাচে, গলিতে ঘুপচিতে, রাস্তায় ময়দানে যখন যেখানে সম্ভব উদ্যাম আনন্দে মাতিয়া ওঠাই যেনো বিশ্ববিদ্যালয়ের মোকশো । আরও জানিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ করিয়াই সাফল্যের দুয়ারে পৌঁছানো যায়, যে সাফল্যের অর্থ দামি গাড়ি ক্রয়। আসলেই আজ মনে হইতেছে বিশ্ববিদ্যালয় হইলো গাড়ি-বাড়ি-নারী লাভের শষ্যক্ষেত্র, নিতান্তই মূল্যহীন কিছু জ্ঞানের জন্য আর যাই হৌক কেহ তো পয়সা খরচ করিতে আসিবে না ।

এককালে জানিতাম, অক্সফোর্ড, কেম্ব্রিজ এসকল নামীদামী পাঠকেন্দ্রে বিদ্যার্থীর সমাগম হতো; সেসব বিদ্যার্থীর মোকশো ছিলো না বাড়ি গাড়ি অর্জন; ছিলোনা বাহারি জীবনের স্বপ্ন । তাহারা জানিত বিশ্ববিদ্যালয় মানে হইলো অনেকটা খাটুনি আর কতোটুকু কষ্টের মাধ্যমে জ্ঞানগুরুর দেখানো পথে চলিতে শেখা । সেসকল বিশ্ববিদ্যালয়ের দেখাদেখি দুনিয়ার তাবৎ স্থানে একসময় নানা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়িয়া ওঠিতে থাকে । আমাদিগের এই বঙ্গদেশেও সরকারি নানান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপনা চলে । কালের আবর্তে সেসবের পাঠের ধারার পরিবর্তন হয় । প্রাথমিক ভাবে আসলেই ছাত্রছাত্রীগণ পার্থিব মোহে নয় আত্মিক বিকাশেই পড়িতে যাইতো; ঠিক চাকরির মোহে নহে । কিন্তু কালে কালে বিবর্তন হয় মানুষের; পরিবর্তন ঘটে বিদ্যার্থীর ।

সময়ের আবর্তে চাকুরির খোঁজ পাইতে গিয়া সকলেই দেখিতে থাকে চাকুরির জন্য দরকার হইতেছে উচ্চ ডিগ্রী । বাঙালি পিতামাতা স্বপ্ন দেখিতে শিখে তাহাদের সন্তান হইবে ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার; কিংবা সরকারি বড় চাকুরে, জজ-মেজিস্ট্রেট-সচিব নয়তো উকিল-ব্যারিস্টার । শিক্ষার্জনের সার্টিফিকেট স্বভাবতই অনেকেরই চাকরির নিয়ামক হইয়া উঠে । গুরুজনের চোক্ষে দ্রষ্টিত স্বপ্ন নিজ আঁখিপটে লালন করিয়া হাজারো বাঙালির পুত্রকণ্যা ভর্তি হইতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে, ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, মেডিকেল কলেজ সমূহে । সেই ১৯৭০ এর দশকে ঝাঁকে ঝাঁকে বাঙালি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হইতো মৌলিক বিজ্ঞান শাখায়; তাহাদের থেকে অনেকেই হইয়াছে বড় আমলা, দেশের মাথা হর্তাকর্তা । দিনে দিনে কমিতে থাকে টাকাপয়সার মূল্য, বাড়িতে থাকে জীবনযাপনের ব্যায়; সরকারি চাকুরির চেয়ে কখনো বেসরকারি চাকরি ও ইঞ্জিনিয়ারিং কিবা ডাক্তারি অধিক লোভনীয় হইতে থাকে; ঝাঁকে ঝাঁক দেশসেরা বাংলাদেশি সুসন্তান সকল বুয়েট/ঢাকা মেডিকেলে পাঠার্জনের চেষ্টায় নিয়ত রীতিমত আদা জল খাইয়া প্রচেষ্টা চালাইতে থাকে; কহিতে লজ্জা নাই আমিও করিয়াছি সে চেষ্টা । কিন্তু তখনো, লোকে কষ্মিনকালেও ভাবিতে পারে নাই যে ৪-৫ বছরের স্নাতক কোর্সে হাসিয়ে খেলিয়া পার করিয়া দেওয়া যাইবে আর নিয়মিত বেতনাদি পরিশোধ করিলেই সময় শেষে হাতে সনদপত্র ধরাইয়া দিবে! স্কুলে-কলেজে তখনো সকলে পড়িতো, শিখিতো — নিগূঢ় তত্ত্ব জানিতে বুঝিতে চেষ্টা তপস্যা করিতো । সেই চেষ্টার ফলশ্রুতিতে এসএসসি, এইচএসসি বিবিধ পরীক্ষা শেষে ভর্তিপরীক্ষা’র যুদ্ধ জয় করে নিজের বুদ্ধির প্রাখর্য ও আত্মিক উন্নয়ন সাধনের অভিলাষ দেখাইয়াই লোকসকল পড়িতে আসিতো । বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকিয়া শিক্ষকদিগের প্রবল চাপে পিষ্ট হইয়া বিদ্যালাভের চেষ্টা করিতেই হইতো । রাজনীতি, সেশনজট, মারামারি এসকলে পতিত হইয়া যদিও পাঠের পরিবেশ দিনে দিনে লাটে উঠিতে থাকে; তবুও বিশ্ববিদ্যালয় মানে যে পড়িবার স্থান, মানসিক সৌকর্য অর্জনের পাথেয় তা সকলেই জানিত ও মানিত । তাই ৪-৫ বৎসরের স্নাতক পাঠ বেশি সময় লাগাইয়া শেষ করিলেও এসকল শিক্ষার্থী কিছু না কিছু বৃহত্তর জীবনের খোঁজ শিখিয়াই বাহির হইতে পারিতো ।

সময়ের বিবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ আজ তাহাদের মূল উদ্দেশ্য হইতে বহুদূর চলিয়া আসিয়াছে । বিশেষ, রাজধানী শহরের নানান পাড়া-মহল্লায় গজাইয়া উঠা অর্ধশতাধিক নানাবিধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনেকেই কেবলই “টাকা দাও, মজা লও, সনদ লও” মন্ত্রে মন্দ্রিত হইয়া নিশিদিন শিক্ষাউদ্ধার করিতেছে । যেসকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তব্য হইতো নূতন-নবীন কিশোর-তরুণের চোখের ধাঁধা দূর করিয়া, বিষম খাওয়া দুনিয়ার ভেল্কি উন্মোচন করিয়া খোলা নয়নে, উন্মুক্ত মননে জগৎ দেখিবার ও পথ চলিবার নির্দেশ করিবার তাহারাই বরঞ্চ আজিকে এইসকল কচিকাঁচার চোখে রঙিন চশমা পড়াইয়া দেখাইতেছে ধূম্রজালের আভরণে ঢাকা চাকচিক্যমণ্ডিত অলীক জগতের মোহমায়া স্বপ্ন; এসকল তরুণ তরুণীর নেত্রপল্লবে নাচিতে থাকে দুর্লভ সবুজ ফেইরির উদ্বেলিত স্বপ্নসাধ, বক্ষ তাহাদের ভরপুর যেন কবি নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার যত জগজ্জয়ী বীরসুলভ তারুণ্যের আস্থায় উপচাইয়া পড়া ভরপুর মদ…হরদম । তাইতো আজিকে পত্রপত্রিকা খুলিলেই নয়নসমুখে আপতিত হয় সেইরূপ কতিপয় বিদ্যাবিপনীর বিজ্ঞাপন যাহাতে বলা হয়: (আমার নিকট তাহাদের বিজ্ঞাপন শ্রুত হয় ফার্মগেট সহ শহরের-গঞ্জের, হাট-বাজারের হকারদিগের বিজ্ঞাপনের ন্যায়, তাই তাহাদের ভাষাতেই উদ্ধৃত করিলাম)

  • এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িলে আপনি জানিতে পারিবেন কিভাবে বাসে ঝুলিয়া রাস্তার ঝকঝকে গাড়ি দেখিতে দেখিতে সেই গাড়ি কিনিবার স্বপ্ন জাগে ও কিরূপে সে স্বপ্ন পূরন করিতে হয়
  • এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িলে আপনি আরও পাইবেন কতিপয় উদ্ধতযৌবনা নারীসহশিক্ষার্থীনি ও আকর্ষণীয় একঝাঁক হ্যান্ডসাম সুপুরষ সহপাঠী
  • এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িলে আপনি সুন্দর সুন্দরী নানানো আত্মাবন্ধু পাইবেন যাহাদিগের সহিৎ নগরের আনাচে কানাচে একসাথে দিবানিশি যাপন করিতে পারিবেন
  • এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িলে আপনি নার্ডদর্শন বেচারা ছেলে হইতে বিবর্তিত হইয়া পরিণত হইবেন সুদর্শন তরুণীর স্বপ্নপুরুষে

এইরূপ নানাবিধ বিজ্ঞাপনই আজিকে চোখে ভাসিতে থাকে দিকে দিকে!

আজ বুঝিলাম, বিশ্ববিদ্যালয় মানে নয় “জ্ঞানের ভারে ভারিক্কী চালে আনত নয়নে কিছু নবতর বিশাল নির্মানের ক্ষীণ প্রত্যাশা লইয়া হাড়ভাঙা খাটুনি অন্তে বিদ্যাপাঠ শেষে দুরুদুরু বুকে সংসারের মাঝে বাহির হওয়া” বরং বিশ্ববিদ্যালয় মানে হইতেছে, “সদাউচ্ছল উদ্ধত বক্ষে আস্থার আগ্নেয়গিরি হইয়া বাঁধভাঙা আয়েশী জীবনযাপন শেষে আরও আয়েশী অলীক স্বর্গলাভের মদিরা স্বপ্নে বিভোর হওয়া”।

জয় গুরু দম বাবা

বিঃদ্রঃ, [১], [২], [৩] এইসকল বিজ্ঞাপনের সহিৎ এই রচনার কোনরূপ সংযোগ নাই; তবে এই বিশেষ বিজ্ঞাপনের সহিৎ থাকিলেও থাকিতে পারে ।

এই রচনাটি কুয়েট-এর প্রকাশমাধ্যম কুয়েট লাইভ এর জন্য লিখিত ও একই শিরোনামে প্রকাশিত

শুদ্ধ কহ বঙ্গভাষা, হে বঙ্গজন

বঙ্গভাষা/বাঙ্গালাভাষা/বাংলা ভাষা — আমার প্রাণের ভাষা, মুখের ভাষা, মনের ভাষা, বন্ধুর সহিৎ কথা কইবার ভাষা, শত্রুকের গালাগাল করিবার ভাষা, লিখিবার ভাষা, গান গাহিবার ভাষা, আনন্দ বেদনার অশ্রুর ভাষা । হৃদয় নিঙরানো অভিব্যক্তির প্রকাশ যেমন বাংলা ভাষায় করি তেমনি মনে মনে অবিরল ভাবি এই বাংলাভাষাতেই । এইরূপে বাংলা ভাষা আমাদিগের জীবনের অংশ হইয়া গিয়াছে । তথাপি, বাংলাদেশে কেহ কেহ বাংলা ভাষা লইয়া ঠিক গর্ব করিতে পারে নাই; যাহারা পারে নাই, তাহাদের বিষয়ে কবি লিখিয়াছেন, “যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী ।\ সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি ॥

আজিকে বাংলায় চারিদিকে অজানা অচেনা কতিপয় ভাষা শুনিতে পাই, বাঙালির মুখে বোল তোলা এ ভাষা বাংলা নহে; তবে তাহা হিন্দি বা ইংরেজিও নহে — এসকল এক জারজ শংকর ভাষার ন্যায়ই প্রতিভাত হয় । ভাষার নানান রূপ থাকিবে, ঠিক যেমনই এক মায়ের অনেক সন্তান থাকে । বাঙলা ভাষার রহিয়াছে তিনটি মান রূপঃ (১) বলিবার মান্য চলিত কথ্য ভাষা (২) লিখিবার মান্য চলিত লেখ্য ভাষা (৩) পূর্বে ব্যবহৃত লিখিবার সাধু ভাষা । লিখিবার ও বলিবার মান চলিত ভাষা আদতে ও প্রথমে একইরূপ ছিল, কিন্তু বলিবার ভাষা হইতে লিখিবার ভাষা অধিক পরিশিলীত ও লিখিবার চাইতে বলিবার ভাষা অধিক সাবলীল বিধায় প্রয়োগ ক্ষেত্রে মান্য চলিত ভাষা লিখিতে ও বলিতে কিছুটা ভিন্নরূপ শ্রুত ও পঠিত হয় বটে । আর লিখিবার জন্য সাধু ভাষা, যা কিনা বড়ই সুমধুর ও সুমিষ্ট কিন্তু ঠিক ততোটা সাবলীল নহে তাহার ক্রিয়ারূপ ও ব্যবহারের আমেজ কিছু ভিন্ন । আজো দলিলে নথিতে সাধু ভাষা লিখিত হইলেও মূলত ইহার প্রয়োগ নাই বলিলেও চলে, বিগত দশকে ইত্তেফাক পত্রিকা সাধুভাষার পরিবর্তে চলিত ভাষায় লেখা প্রকাশ করিতে শুরু করিলে সাধুভাষা প্রায় হারাইয়া যায় । এই তিন মান ভাষা ছাড়াও রহিয়াছে প্রতিটি অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা, যেমন ময়মনসিংহ জেলা ভাষা, কুষ্টিয়া জেলা হইতে অনেক আলাদা – এইসব আঞ্চলিক ভাষা বহুকাল ধরিয়া গড়িয়া উঠে বিধায় এসকল বাংলা ভাষার সম্পদ । এছাড়াও, ঢাকা শহরের নতুন অধিবাসীগণ – যাহারা বিভিন্ন অঞ্চল হইতে আসিয়াছে তাহারা সকলে একটি বিশেষ রূপে কথা কহেন । একই বিশ্ববিদ্যালয়ে বা পাঠতীর্থেও ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষার্থী থাকে বিধায় সেখানে কথায় বেশ কিছু ভিন্ন ভিন্ন আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয় ।

এইসকল ঠিক ছিল, উপরন্তু বাংলার এই নানারূপ ব্যবহার ভাষাকে সমৃদ্ধ করিয়াই চলিতেছিল; কিন্তু গোল বাঁধিল তখনি যখন কতিপয় পেশার লোক কৃত্রিম কিছু বাংলা ভাষার রূপ আমদানি করিতে থাকিলেন । নতুন কিছু বেসরকারী বেতার মাধ্যমে আরজে বা রেডিও জকি নামে পরিচিত পেশাজীবি নবশিক্ষিত যুবক উত্তরাধুনিক বাংলা ভাষার যে রূপ লইয়া আসে তাহাতে শোনা যায়, আজগুবি উচ্চারণে ইংরেজি উর্দু শব্দে ঠাসা বাংলা ভাষা, যা শুনিলে আমাদিগের মনে হইতে থাকে, কেহ কথকের গলা চাপিয়া ধরিয়াছে ও পশ্চাৎদেশে প্রবল বেগে আঘাত করিতেছে – সেই আঘাতের তালে তাল করিয়া কথক দ্রুত ইংরেজের ন্যায় উচ্চারণে কহিতে থাকে । কোন এক অদ্ভুদ কারণে, বাংলা অভিধানের সুন্দর সুন্দর শব্দ বাদ দিয়া তাহারা ইংরেজি শব্দ ভুলভাবে ব্যবহার করিতে থাকে; কখনো কতিপয় ইংরেজি শব্দ তাহারা এমনেতর অর্থে ব্যবহার করে যাহা খাস ইংরেজেরও অজানা ছিল, আর সেসকল শব্দের উচ্চারণ না হয় ইংরেজের ন্যয় না বাঙালির ন্যায় । একইরূপ উচ্চারণ ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত হয়, নব্য আধুনিক অনেক পেশাজীবি, যাহারা কিছুটা চিবিয়ে বাংলা না বলিলে ঠিক স্মার্ট হওয়া যায় না বলিয়া মনে করে ।
বিশেষ দুঃখের কারণ হইয়া দাঁড়ায় যখন দেখা যায়, বিভিন্ন উচ্চশিক্ষিত লোকজন বাংলায় কথা বলিবার সময় প্রচুর পরিমাণ ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করিতেছে, তাহাদের বাংলা উচ্চারণ উত্তম ও সুন্দর হইলেও বিভিন্ন কথা বলিবার সময় কোন এক কারণে তাঁহারা বাংলা শব্দ খুঁজে পাইবার আগেই ইংরেজি শব্দ ঠোঁটের আগায় চলিয়া আসে; এই শ্রেণীর ব্যক্তিসকল পূর্বে উল্লেখিত শ্রেণীদ্বয়ের ন্যয় ইচ্ছাকৃত ইংরেজি শব্দের বাহার লইয়া বসে না, বরং বাংলা সেসকল শব্দের নিয়মিত ব্যবহার না করিবার কারণেই বাংলা ব্যবহার করিতে ভুলিয়া যায় । এর কারন হিসেবে বলা চলে, বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তক, পত্রিকা, নথি ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ সকলই ইংরেজিতে পঠিত হয়; হয়তোবা দেশে বিদেশে সেমিনার সকলে লিখন ও পঠণ সকল রচনাই হয় ইংরেজিতে; তাই মস্তিষ্কে ইংরেজি শব্দগুলোই এসকল ধারণার সাথে সরাসরি গাঁথিয়া যায় – মাতৃভাষা বাংলার শব্দই উল্টো যেন অনুবাদ করিয়া স্মরণে আনিতে হয় । এই অসুবিধা ও অনভ্যাস দূর করিতে আসলে আমাদিগের উচিৎ হইবে, বাংলায় পাঠ্যাভ্যাস বৃদ্ধি করা, বিভিন্ন পাঠ্য ও গুরুত্বপূর্ণ মননশীল বই ও জ্ঞানগ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করিয়া বাংলায় পাঠের ব্যবস্থা করা । আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পত্রিকাদির দেশীয় সংস্করণ করিলে তাহা ঠাঁট বজায় রাখিবার তালে ইংরেজিতেই না করিয়া বাংলায় প্রকাশ করা ।

শিশুসকল, কিশোরেরা, ভবিষ্যতের যে প্রজন্ম তার এক বড় অংশ ভাষা শিখিতেছে আজব উপায়ে; কেহ কেহ ঠাঁট ও ভাব বজাইতে গিয়া ইংরেজি মাধ্যমে পড়িতেছে, কেহবা দেশীয় পাঠ নিচ্ছে ইংরেজি ভাষায়, আর যাহারা বাংলাতেই দেশীয় পাঠ নিচ্ছে, তাহারাও নিত্য দেখছে হিন্দি টিভি অনুষ্ঠান – চলচ্চিত্র , শুনিতেছেও হিন্দি গান । তাহারা বাংলায় কথা না বলিয়া তাই হিন্দিতে পারদর্শী হইয়া উঠিতেছে । আরও মজা হইতেছে, যখন আমরা কোন পাকি বা ইন্ডির সাথে সাক্ষাৎ পাই, তখন বাংলা ছাড়িয়া হিন্দি-উর্দু মিশাইয়া কথা কহি; ইংরেজি ব্যবহার করিলেও নাহয় হইতো — আসলে আমাদিগের ভাষাকে মর্যাদাই দিতে চাহি নাই আমরা!

এই যে বাংলা ভাষার নানারূপ লইয়া আর ইহার দূষণ লইয়া এত কথা লিখিলাম, তাহার কারণ মূলত আজিকে প্রাতে পঠিত সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের রচিত এক নিবন্ধ যাহা দৈনিক প্রথম আলোর উপসম্পাদকীয়তে ‘ভাষা দূষণ নদীদূষণের মতোই বিধ্বংসী’ শিরোনামে প্রকাশ হয় । এরই রেশ ধরিয়া উচ্চ আদালত বেতার টিভিতে ভুল উচ্চারণে বাংলা কহিতে নিষেধ করিয়া এক নির্দেশ দেন । এই নির্দেশেই বাংলা ভাষার ভুল ব্যবহার বন্ধ হইয়া যাইবে না; তবে ইহাতে জোর আলোচনা হইবে কিছুকাল, যা কিছুটা হইলেও আমাদিগের সকলের চেতনা কিছুকালের জন্য হইলেও জাগ্রত করিবে – আমরা অনেকেই ভুল বুঝিতে পারিয়া সঠিকভাবে আমাদের এই প্রিয় বাংলা ভাষা ব্যবহারে উদ্যত হইবো ।

আর শুধু ফেব্রুয়ারিকে ভাষার মাস, এসময়ই কেবল “ভাষা ভাষা” করিতে হইবে এমন ধারণা হইতে বাহির হইয়া, বাংলা ভাষাকে সত্যই প্রাণে ধারণ করিলে বৎসরের প্রতিদিনই সুন্দরভাবে সঠিক বাংলা বলিতে ও লিখিতে সচেষ্ট হইতে হইবে ।

সালতামামিঃ ২০১১পাঠ

দুই সহস্র একাদশ সাল — খৃষ্টীয় অব্দের ২০১১তম বৎসর; বহুকাল ধরিয়া এই সালগণনা পদ্ধতিকে অ্যানো ডোমিনি বা “প্রভু’র বৎসর” বলিয়া আসিতেছি, কিন্তু অধুনা ইহাকে কমন এরা বা “সাধারণ সাল” বলিবার চল হইয়াছে – কারন এইটিই সর্বধিক ব্যবহৃত পঞ্জিকা-বৎসর যা একসময় কেবল চার্চ-শাষিত বা খৃষ্টানপ্রধান য়্যুরোপে ব্যবহৃত হইলেও এখন ধর্ম ও জাতি নির্বিশেষে তাবৎ দুনিয়াতেই ব্যবহৃত হইতেছে ; ডিজিটাল ব্যবস্থা, কম্পিউটারে, আন্তর্জাতিক মান্য ব্যবস্থায়ও এটিই একমাত্র সর্বজনস্বীকৃত সাল – সেজন্যই কমন এরা ।

যাহাই হৌক, প্রতিবছরের ন্যায় ২০১১-ও অনেক আশা আকাঙ্ক্ষা লইয়া আমাদের মাঝে আসিলেও নানাবিধ প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি নিয়াই এই বছরের সমাপ্তি – তাই বৎসরের শেষ ঘন্টায় বসিয়া (লিখিতে শুরু করিলেও শেষ করিতে পারি পরের দিবসে) ব্যক্তিগত, দেশীয় ও অন্যান্য আঙ্গিকে বৎসরটির কিছু দিক ফিরে দেখিতে উদ্যত হইলাম ।

ব্যক্তিগত পর্ব
২০১১ সাল আমার জীবনে মাইলফলক বৎসর না হইলেও বেশ কিছু ঘটনায় আলোকিত – গতবৎসরের শেষে পাসপোর্ট সংগ্রহের আবেদন করিলে মাত্র দুই কি তিন মাস অতিক্রান্ত না হইতেই এবৎসর জানুয়ারিতে আমি বাংলাদেশের পাসপোর্ট হাতে পাই । এই বৎসরেই আগস্টের শেষে আমি কর্মক্ষেত্রের প্রয়োজনে স্যামসং সদরদপ্তর – কোরিয়াতে দুই মাসের ভ্রমণে যাই । তার কিছু পূর্বেই আমি বিশ্বের সকল স্থানের জন্য মুসলিম নামাজাদি, ইফতার-সাহরির সময় গণনা করিবার ওয়েবভিত্তিক ওয়াক্তস্কোপ নামীয় এক বস্তু তৈয়ারি করি – কোরিয়া সফরে ইহা আমারও বিশেষ কার্যে আসে । গ্রীষ্মের শুরুতে আমি আমার ওয়েব সাইটের সহিৎ ওয়ার্ডপ্রেস নামক ওয়েব-প্রকাশনা সহায়ক বস্তুখানি সংযোজন করি এবং সময়ের স্বল্পতা থাকিলেও কিছু থিমও তৈরি করিয়া ফেলি – যার দরুন আমি “সাধুবচন” নামীয় এই খেরোখাতা প্রকাশ করিতে শুরু করিতে পারি; সাধুবচনে মূলত আমি সাধুভাষা চর্চা করিয়া নিজ মনোভাব প্রকাশের চেষ্টা করিতেছি – একই সাথে যাহাতে বাংলাভাষার এই বিশেষ স্বাদুরূপ কালেভদ্রে পঠিত-লিখিত হইয়া জীবিত থাকিতে পারে সেই আশাও প্রেরণার রূপ যুগাইয়াছে । কিছুকাল পর আমার কাব্য-কুকর্মের খাতা “সুলল সংগ্রহ“-ও ওয়েবমাধ্যমে প্রকাশ করিতে শুরু করিয়া দেই এবং সেই আনন্দে ধেই ধেই করিয়া নাচিয়া নতুন কতিপয় কাব্যও (নয়খানা পদ্য ও আষ্টখানা লিমেরিক) রচনা করিয়া বসি – এর পূর্বে প্রায় চারি বৎসর কাল ঠিকমত কাব্যচর্চা করিতেই পারি নাই ।
২০১০ সালে জন্মদিনোপলক্ষে আব্বার নিকট হইতে কম্পিউটারযোগে আঁকিবার জন্য ব্যবহৃত ড্রয়িং প্যাড উপহার পাইলে এই বৎসর তৎযোগে কিছু চিত্রাঙ্কেনরও অবকাশ হয় – তাহা সত্ত্বেও এই বৎসরে মাত্র পঞ্চখানি দেয়ালচিত্র কাস্টোমাইজ.অর্গ-এ প্রকাশ করিতে সক্ষম হই । ইহার মধ্যে অবশ্য একুশে ফেব্রুয়ারী লইয়া বাংলা বর্ণসমূহের সমন্বয়ে কৃত চিত্রখানি বন্ধুমহলে বিশেষ সমাদর প্রাপ্ত হয়। কিয়দ পরেই বাংলা নববর্ষ লইয়া কৃত নববর্ষ শিরোনামের কার্য – ঠিক মনঃপূত না হইলও ইহাও বেশ কদর পাইয়াছে । বিগত বছরের ন্যায় এই বছরেও বারকয়েক গুগল ডুডল বানাইতে ইচ্ছা পোষণ করিলেও আমি, সিয়াম, ফাহিম বা প্রতীকের মধ্যে কেউই কাজটি সম্পন্ন করিতে পারি নাই; পরিশেষে বিজয় দিবস উপলক্ষে দিবসের ২-৩দিন পূর্বে অকস্মাৎ সাইবারজবৎ জুড়িয়া গুগল ডুডল করিবার জোড় তৎপরতা শুরু হইলে আমার এক অনুজ আশিক রহমান অপু আমার একই দিবস উপলক্ষে কৃত বিজয় আনন্দে আজ এর উপর ভিত্তি করিয়া ডুডল প্রস্তাব করে । অতঃপর, সকলেই যখন জানিতে ও বুঝিতে পারে যে ১-২ দিনের মধ্যে কোন রূপেই গুগল ডুডল প্রদান সম্ভব নহে তখন সাইবার জনতা পরবর্তী একুশে ফেব্রুযারীতে অনুরূপ কিছু করিবার আশা প্রকাশ করে… আমি ও প্রতীক এইবার আর অলসতা না করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করি ।

জানুয়ারিতে আমার ইংরেজি ভাষার ব্লগখানি ১৫ সহস্র পাঠক ছাড়াইয়া যায় – বৎসর শেষে তাহা চল্লিশ সহস্র-ও ছাড়াইয়া যায় – এবছরের শুরুতেই উক্ত ব্লগখানিকে আমি আমার নিজস্ব ঠিকানা ins.nafsadh.com তে প্রকাশ করিতে শুরু করি যাহা পূর্বে ওয়ার্ডপ্রেস.কমের ঠিকানায় প্রকাশ হইতো ।

এবছর মার্চে আমার সুপ্রিয় পিতামহ অকস্মাৎই পরলোকগমণ করেন, অশ্রুসিক্ত নয়নে তাঁহাকে বিদায় দিয়া আসি ১১ মার্চ তারিখে। তিনি অসুস্থ হইয়া ঢাকায় হাসাপাতালস্থ হইলেও তাঁহার সহিত শেষ দর্শনের সুযোগ হয় নাই – এই ক্লেশ আমার রহিবে। তাঁহাকে হারনোর বেদনা আমাকে ও আমার পরিবারের সকলকে মর্মাহত করে। আল্লাহ তাঁহার আত্মার মাগফিরাত করুন ও তাঁহাকে জান্নাতের উত্তম স্থান দান করুন। আমীন॥

২০১১ সালের কতিপয় ঘটনার মধ্যে এই মূহুর্তে স্মৃত হইতেছে যে, জানুয়ারিতে আমার মাতৃকুলসম্বন্ধীয় ভ্রাতাভগ্নিগণের সহিৎ টাঙ্গাইলে বিশেষ মিলন হয়; এই মাসেই কতিপয় বন্ধুর সহিৎ বানিজ্য মেলা নামের কারবারে আমরা যাই – বন্ধুসহযোগে ইহা আমার প্রথম বানিজ্যমেলা ভ্রমণ, ইতঃপূর্বে পারিবারের সহিত যাওয়া হইয়াছিল – যদিও অধিক জনসমাবেশ আমাকে বিশেষ আনন্দিত করিতে পারে না । ফেব্রুয়ারির বইমেলা বাঙালির বিশেষ আনন্দের উৎস এবং এই বৎসর যথেষ্ট আয়েশের সহিৎ বার কয়েক বইমেলা গমন করিতে পারি – যদ্যপি পূর্বের ন্যায় বইমেলায় ভিড় আর দৃষ্ট হয় না – তথাপি বইমেলা আমার প্রাণের মেলা হইয়াই আসে। ২০১০ সালে পরীক্ষা থাকার দরুন বইমেলায় আসিতে পারি নাই, এবং তার আগের ০৭,০৮,০৯ ও বিশেষ আয়েশের সহিৎ বইমেলা ভ্রমণ হয় নাই। আমরা ইহার মাঝেই “বর্দ্ধমান হৌজ” তথা বাংলা একাডেমি মূল কার্যালয়-ও দর্শন করি । ফেব্রুয়ারিতে আমি অর্ক ও শোভনের সহিৎ প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন বা নাড়িকেল জিঞ্জিরা’য় অবকাশ ভ্রমণ করি – ইচ্ছা সত্ত্বেও সংবর্ষে এই একের অধিক আর সফরে যাইতে পারি নাই । পঞ্চবৎসর পূর্তি উপলক্ষে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট সিএসই ২কে৫) বন্ধুগণ একত্রে মিলিত হই মার্চের ৫ তারিখে । আমাদিগের পুরুষ বন্ধুগণের মধ্যে সর্বপ্রথম বিবাহের বন্ধনের আবদ্ধ হইল রাহ্‌হ্‌হ্‌ ভাই এই জুন মাসেই । রমাদানের মধ্যখানে হঠাৎ টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হইয়া আমি কিছুকাল হাসপাতালে যাপন করি – এতদহেতু আমাকে স্বীয় উদ্যোগে আয়োজিত বন্ধুসকলের ইফতার খানা-আয়োজন পরিত্যাগ করিতে হয়। সুস্থ না হইতেই আমি কোরিয়া ভ্রমণে চলিয়া যাই । কোরিয়াতে সিউল ও সুওন সংলগ্ন বিভিন্ন স্থান সন্দর্শন হয় ও বিশেষ অভিজ্ঞতা প্রাপ্ত হই । অক্টোবরে স্বীয় ওয়েবগৃহের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করিতে সক্ষম হই । একালেই আমি প্রথম ত্রিমাত্রিক চলচ্চিত্র দর্শনের স্বাদলাভ করি – যদ্যপি মুভিখানার নির্মান বিশেষ প্রসিদ্ধ হয় নাই – তথামি ত্রিমাত্রিক চিত্র বলিয়া কথা । নভেম্বরে আমি আমার আলমা ম্যাতার তথা শিক্ষণমাতৃকা কুয়েট হইতে ঘুরিয়া আসি – উক্ত স্থান আমার নিকট বিশেষ আবেগের স্থান । আমাদিগের সুহৃদ অভি উচ্চশিক্ষার্থে মার্কিন মুলুকে গমন করে বছরের শেষলগ্নে ।ডিসেম্বরে পুনরায় চন্দ্রগ্রহণ সংঘটিত হয় – জুনমাসের চন্দ্রগ্রহণ মেঘরাজিকার হেতু দৃষ্ট না হইলেও এইটি সম্যক দৃষ্ট হয় । এইসকল ব্যতিকরেকেও আরো নানাবিধ ক্ষুদ্র-বৃহৎ ঘটনার দ্বারা পরিবৃত হইয়া বছর যাপিত হইলো… এক্ষণে ইহাকে বিদায় জানাইতেছি ।

দেশ ও বিশ্ব পর্ব
বর্ষটি দেশে ও বিশ্বে নানাবিধ আলোচিত ঘটনার দ্বারা অতিক্রান্ত হয় । জানুয়ারির মাঝামাঝি ফেলানির ঘটনায় সমগ্র দেশ বিক্ষুব্ধ হইয়া বৎসরের সূচনা করে, ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর কতিপয় ঘটনাও প্রভূত আলোড়ন সৃষ্টি করিয়াছিল । ১৭ ফেব্রুয়ারি এক অসাধারণ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশ ভারত ও শ্রীলঙ্কার সহিত সম্মিলিতভাবে বিশ্বকাপ ক্রিকেট আয়োজনের শুভসূচনা করে – উদ্বোধন অনুষ্ঠান ভারতের শিধু সিং ও কতিপয় ব্যক্তি ব্যাতীত তাবৎ দুনিয়ায বিশেষ প্রসংশা পায় – লোকে কহিতে থাকে ক্রিকেটে এমন অনুষ্ঠান আর হই নাই। তবে আমরা বিশ্বকাপে দ্বিতীয় পর্যায় (রাউন্ড) এ যাবার আশা করিলেও তাহা হয় নাই – ফলে ক্রীড়ামোদি আমরা বিশেষ আশাহত হই ।
মার্চ মাসে ড. ইউনুস ও গ্রমীণ ব্যাংকের সহিত সরকারি আচরন লইয়া সারাদেশ বেশ চঞ্চল হইয়া উঠে – আদালতের রায় লইয়া বিবিসি মত দেয়, “আদালত যেন শাষকের দর্পন”। বিশ্বের বিভিন্ন স্থান হইতেও এই ঘটনা লইয়া বেশ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আসিতে থাকে ।
১১ মার্চে জাপানের সুনামি ও তাহার ফলশ্রুতিতে ফুকুশিমা ট্রাজেডি সমগ্র বিশ্বকে আলোড়িত করে, বিশেষ করিয়া প্রযুক্তিবিদগণ পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রযুক্তিকে আরো গভীরভাবে ভাবিবার অবকাশ পান।
মার্চেই সাংসদ আন্দালিবের বক্তব্য বিশেষ আলোচনার সৃষ্টি করে ও বিভিন্নমাধ্যমে উহার ভিডিওচিত্র অবশ্য দ্রষ্টব্য হইয়া পরে । এপ্রিলে জাতীয় নারীনীতি লইয়া বিশেষ দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় এবং ইহা লইয়া হরতাল ও বিশেষ রণাবস্থার অবতারণা হয়।
মে মাসে বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য ব্যারেলপ্রতি ১০ডলার হ্রাস হইলেও পক্ষান্তরে বাংলাদেশে লিটারপ্রতি দুই টাকা বৃদ্ধি হয় – পরবর্তীতে আরও কয়েক দফা গ্যাস ও তেলের মূলবৃদ্ধি ঘটে; বর্ষের শেষে আসিয়াও তেল লিটারপ্রতি ৫টাকা বাড়ে, গ্যাসের মূল্য ১৬ টাকা হইতে তিনগুণ বাড়িয়া যায় – বিদ্যুৎ ও গৃহস্থলী গ্যাস সরবরাহেরও অবস্থা তথৈবচ । মে মাসের এ সময়েই-ই রবি ঠাকুরের জন্মের দেড়শতবর্ষ জয়ন্তী পালিত হয় এবং এর কিছু পাশ্চাত্যকরণের বিশেষ সমালোচনার সৃষ্টি করে । জুনে ঢাকা ফ্যাশন উইক একাধারে ব্যবসায়িক সাফল্য ও নাগরিক সমালোচনা লাভ করে ।
ভিকারুন্নিসার পরিমল কাহিনী-ই থাকে জুলাইয়ের মূল আলোচনার বিষয় । জুলাইতে আদমশুমারির প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় যাহাতে দেশের জনসংখ্যা অনুমিত ও পূর্বের জরিপের তুলনায় কম বলিয়া প্রতিভাত হয় । আগস্ট মাসে, তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর সহ কিছু খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হইলে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা লইয়া বিশেষ বিতন্ডা মঞ্চস্থ হয় । এই বৎসর আমেরিকা ও ভারতের মডেল অনুযায়ী বাংলাদেশেও “কে হতে চায় কোটিপতি” শীর্ষক অনুষ্ঠান শুরু হয় বাকের ভাই খ্যাত সাংসদ নূরের উপাস্থাপনায় । অক্টোবরে সাইবার জগতে বাঙালি-বাংলাদেশি প্রশ্ন কিছুটা আলোচনার অবকাশ পায় ও এই লইয়া আমার খেরোখাতায় পূর্বতন লেখাটি লিখিত হয় । পদ্মা সেতু লইয়া বৎসরের শেষদিকে মাঠ উত্তপ্ত হয়। টিপাইমুখি বাঁধ লইয়া সরকারের ভূমিকা প্রশ্ন সৃষ্টি করে নভেম্বর ও ডিসেম্বরেও । পাক-বাংলা ক্রিকেট খেলায় কিছু বাংলাদেশি নাগরিকের পাকি-সমর্থন বিশেষ নিন্দা ও দুশ্চিন্তার বিষয় হইয়া ওঠে এ সময় । বিজয়ের মাসেই মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীন বাংলাদেশের বিরোধে অবস্থান কারীদের নেতা হিসেবে পরিচিত গোলাম আযমের সাক্ষাৎকার অনেকের আলোচনায় উঠিয়া আসে; যুদ্ধাপরাধের বিচার সহ বেশ কিছু বিষয় এসময় আলোচিত হইতে থাকে।

উত্তাপসৃষ্টিকারী নানা ঘটনার হেতুই বোধ করি, বৎসরের শীত বেশ জাঁকোয়া রূপে আবির্ভূত হইলেও দক্ষিণায়নের দিন হইতেই হঠাৎ করিয়া শীত কমিয়া বেশ গরম অনুভূত হইতে থাকে ।

বাংলাদেশ এ বৎসর রাশিয়ার সহযোগিতায় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির চুক্তি করে আবার রাশিয়ার সৈনিকদের প্রশিক্ষণ দেবার আরকটি চুক্তিও হয়।
২০১০ এ সৃষ্ট পুঁজিবাজার অস্থিরতা ২০১১ জুড়েও চলিতে থাকে ।

বৎসর জুড়িয়া বিশ্বজুড়ে সর্বাধিক আলোচিত বিষয়ের মধ্যে স্থান লইয়াছিল মূলত আরব বসন্ত; এতদ্ব্যাতীত ফুকুশিমা পারমাণবিক কেন্দ্র, স্বর্ণের মূল্য বৃদ্ধি, মার্কিন ডলারের মূল্য বৃদ্ধি, জ্বালানি মূল্যের নিয়মিত হ্রাসবৃদ্ধি ইত্যাদি বিশ্বমাধ্যমে আলোচিত হইয়াছে ।

প্রযুক্তি পর্ব
বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক কোন বহুজাতিক কোম্পানির গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্যামসং আরএ্যান্ডডি ফেব্রুয়ারিতে আত্মপ্রকাশ করে – ইন্টেল, এলজি, এএমডি, আইবিএম সহ কতিপয় আরো কিছু প্রতিষ্ঠানের গবেষণাগার খুলিবার প্রচেষ্টার কথাও আমাদের কর্ণগোচর হয় । মাইক্রোসফটের ইমাজিন কাপে এবৎসরই বাংলাদেশ তলিকাভুক্ত হইয়া অংশ লয়, মাইক্রোসফট ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার ৬ কে অতিবৃদ্ধ ঘোষণা করিয়া ইহা প্রতিস্থাপনে উদ্যত হয় । এবৎসর এইচটিএমএল ৫ প্রকাশিত হয় ও সকল প্রধান ব্রাউজার নতুন প্রযুক্তির উৎকর্ষে আরও ব্যবহার-মনোহর হইয়া উঠে । এপ্রিল ফুল বা বসন্তের বোকা বানাইবার উৎসবে গুগল এবার সর্বাধিক ধোকা (hoax) ছাড়িয়া বিশেষ খ্যাতি পায়, গুগলের সিইও পদ এরিক স্মিড্থ ছাড়িয়া দিবার পর প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজ আবারো সিইও হন। গ্রীষ্মেই কিউবি তাহাদের ইন্টারনেট সংযোগের গতি পরীক্ষামূলক ভাবে দ্বিগুণ করিয়া দেয় ও পরে সকলের সংযোগ-গতিকে দ্বিগুণের স্থায়ী রূপান্তরিত করে । বিশ্বের সর্ববৃহৎ অনলাইল ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান জিংগা শেয়ার মার্কেটে প্রবেশ করে । গুগল জুন-জুলাইতে মরিচার ন্যায় লাল বর্ণ ধারণ করিতে শুরু করে ও গুগল প্লাস প্রকাশ করে – যাহা সূচনায় বিশেষ আকর্ষণ সৃষ্টি করিয়া খোমাখাতা ফেসবুককে হূমকির মুখে পতিতে করিলেও বছর শেষ না হইতেই গুগল প্লাস কোনক্রমেই ফেসবুক কে হটাইয়া মূল ধারা হইতেছে না – এইটি প্রতীয়মান হয় । এছাড়া, স্যামসং মোবাইল বিভাগের সফল সিটিও ওমর খান কোম্পানি ছাড়িয়া যান বৎসরের মধ্যদিকে; আগস্টের ৬ তারিখ ওয়েবের ২০ বছর পূর্ণ হয়; দোয়েল নামীয় বাংলাদেশে সংযোজিত ল্যাপটপ বাজারজাত হইয়াছে ২০১১ সালে । ফেসবুক এবর্ষেই তাহাদের প্রোফাইলের নতুন ধারণা টাইমলাইন প্রচলন করে ।
এই বৎসরেই আইবিএম পিসির ৪০ বৎসর পূর্ণ হয় এবং তাহা হইতে না হইতেই এই প্রযুক্তির পুরোযায়ীগণ কর্ম ও বিশ্ব ত্যাগের যাত্রা শুরু করেন । আগস্টে দায়িত্ব ছাড়িবার কিয়দপর অক্টোবরে দুনিয়াও ছাড়িয়া যান কম্পিউটার প্রযুক্তির অন্যতম মহান কারিগর স্টিভ জবস। একই মাসে প্রোগ্রামিং ভাষা সি ও প্রাচীন কম্পিউটার ব্যবস্থার জনক মহান ডেনিস রিচি-ও ইহধাম ত্যাগ করেন।

যাহাই হৌক, অন্যান্য বর্ষের ন্যায় ২০১১ও নানাবিধ ঘটনায় রঞ্জিত হইয়া আমাদের ছাড়িয়া গেলো।

২০১১ শেষ করিয়া ২০১২’র শুরুতেই দুটি দুঃসংবাদ শুনিলাম, এক বর্ষের প্রথম প্রহরে বুয়েটের রণক্ষেত্র হইবার ঘটনাটি জানিলাম – আর সকালের নিদ্রা ভাঙিল একজন সহপাঠী ও সুপ্রিয় বন্ধুর হঠাৎ আমাদের ছাড়িয়া যাইবার ঘটনা জানিয়া । দুইটিই অবশ্য ২০১১ তে ঘটিয়াছে, কিন্তু জানিতে পারি ২০১২তে । সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানাইলেও তাই কহিতে পারিনা আসলে কিরূপ হইবে এই বর্ষ ।

চাঁদের হরণ

বাঙালি সর্বদাই দড় রোমান্টিক, সৌন্দর্যরস তাহাদের প্রবল, সেইসাথে প্রকট তাহাদের উপমার বাহার। আম্মো বাঙালি, তাই আমিও কম যাই না বাঙালির এইসব গুণে! যাহা হউক, আমরা চন্দ্র-কে বড়ই পেয়ার করিয়া থাকি; উন্মাতাল সৌন্দর্য, নিরূপম নিষ্কলঙ্ক লাবণ্য ইত্যাদি বহুগুণ রূপ বুঝাইতে আমরা চাঁদবদনের উল্লেখ করিয়া থাকি। আবার, আমরা জ্ঞাতি গোষ্ঠীতে চাঁদ মিঞা, অমুক “চন্দ্র” তমুক কিংবা কিষাণ চন্দর – মানবসন্তানের ইত্যাকার বিবিধ নামও শুনিয়া থাকি। চন্দ্রাবতী, চাঁদনী এরূপ নামও বৈ কম নাই। আবার ইতিহাসের পাতা উল্টাইলে দেখা যাইবে যে, চন্দ্র বংশ নামীয় এক রাজবংশ আমাদের ভূমিতে শাসন করিত। আজকাল চলিত ভাষার ব্যবহারে চন্দ্র শব্দ হারাইয়া যাইতেছে, তদস্থলে “চাঁদ” আর কথ্য ভাষায় কখনোবা “চাঁন” এরকম শব্দ অধিক শ্রুত হয়। স্মৃতি হাতড়ে দেখি, শৈশবে ব্যাকরণের বাগধারা অধ্যায়ে আমরা “অর্ধচন্দ্র দান” বচনখানি অধ্যয়ন করি যাহার অর্থ গলা-ধাক্কা দিয়া তাড়াইয়া দেওয়া।

আজিকে শুনিলাম, আকাশের যে চাঁদ – ধবধবে সফেদ চন্দ্র, তাহাকে নাকি কে হঠাৎ অর্ধচন্দ্র দিয়া আকাশ হইতে খেদাইয়া দিবে! কি বিচিত্র কথা। আজিকে পূর্ণিমা – অর্থাৎ কিনা পূর্ণচন্দ্র, পূর্ণচন্দ্রকে দিবে অর্ধচন্দ্র! নাহ্‌, হাসিয়া বাঁচি না। এইরকম খবর শুনিয়া, সিদ্ধান্ত লইলাম, সারারাত্র বসিয়া আকাশপানে চাহিয়া দিইব চন্দ্র প্রহরা। চাঁদমামুকে লইয়া যাইতে দিব না কিছুতেই।

আকাশ হইতে চন্দ্র হারাইয়া যাইবার ঘটনা-কে অনেকে বলে চন্দ্রগ্রহণ, আমি কইব চন্দ্রহরণ। হিন্দু পুরাণে ইহার উল্লেখ রইয়াছে, বলা হয় রাহু চন্দ্র কে গিলিয়া খাইলে চন্দ্রগ্রাস হয়। বিবিধ উপাখ্যান হইতে জানা যায় যে:
রাহু হইতেছে মায়াদানবের ভ্রাতা দানব বিপ্রচিত্তি’র ও সিংহিকার সন্তান। সমুদ্রমন্থন হেতু অমৃত উঠিয়া আসিলে, দেবগণ তাহা খাইবার মনস্থির করে; কিন্তু সেইরূপ করিবার পূর্বেই রাহু অমৃত পান করিতে শুরু করিয়া দেয়। রাহু অসুর বলিয়া সে অমৃতের ভাগ পাইবে না, এবং রাহুর এহেন কীর্তির কথা চন্দ্রদেব ও সূর্যদেব রাষ্ট্র করিয়া দেয়; তৎক্ষনাত বিষ্ণুর স্ত্রীরূপধারী অবতার মোহীনি রাহুর শিরচ্ছেদ (নাকি ধরচ্ছেদ) করিয়া দেয়। ততক্ষণে অমৃত কিছু মাথা ও গলদেশে থাকিয়া যাওয়ায় রাহুর মাথা অমর হইয়া যায় কিন্তু ধর মরিয়া যায়। তারপর হইতেই ক্ষোভবশত রাহু নিয়মিত চন্দ্র ও সূর্য কে গ্রাস করিয়া শোধ লইতেছে। ইহাই হইতেছে চন্দ্রগ্রহণের একখানা বহুকাল যাবৎ জানা মূল রহস্য।

এই উপাখ্যান ছিল ভালো ছিল, কিছুকাল পূর্বে বিজ্ঞানীগণ আসিয়া ভিন্নতর কারন ব্যাখ্যা করিলেন। বিজ্ঞানীদিগের লইয়া এই এক যন্ত্রণা, সবকিছুতেই তাহারা যুক্তি দিয়া ব্যাখ্যা করিয়া আসল কাহিনী জানাইয়া দিতে চান। তাহারা কহেন, পৃথিবী ও চন্দ্রের গতিপথ এইরূপ যে, পূর্ণিমার কালে চন্দ্র, সূর্য ও পৃথ্বী একই রেখায় থাকে এবং কখনোবা তাহার সমপাতিত হইয়া যায়। আর তা হইলেই দুনিয়া চন্দ্রকে ঢাকিয়া দেয়। ক্যায়া আজিব বাৎ! পৃথিবী যদি চন্দ্রকে ঢাকিয়াই দিল তাহা হইলে কী দুনিয়ার তাবৎ মানুষ যাইয়া চন্দ্রে পতিত হইবে না?

যাহা হইক, আপাতত এইটুক লিখিয়াই কলম থামাইলাম; সময় হইয়া গিয়াছে, গিয়া চন্দ্রকে প্রহরা দিতে হইবে। সেই সাথে মূল রহস্য কি তাহও জানিয়া ও দেখিয়া আসি।

শুরুর কথা

প্রথমেই শিরোনামখানা এইরূপ দিবার সার্থকতা আলোচনা করিঃ
ইতঃপূর্বে আমি এই খেরোখাতায় প্রাককথন লিখিয়া সাধুবচন রচিবার প্রয়াসের প্রেক্ষাপটের কথা কিছু বলিয়াছিলাম, আজিকে আরও কিছু বলিবার সাধ জাগিল, সবই প্রেক্ষাপটের কথন নয়, মনের মধ্যে যাহা আসিবে তাহাই কহিব। এবম্বিধ কারণেই শিরোনাম এমতি।

এক্ষণে সাধুবচনের নামের অর্থ লইয়া আলোকপাত করা যাক; আমি শব্দ লইয়া মজা করিতে পছন্দ করি তাই এই খেরোখাতার নাম করিয়াছি দ্ব্যর্থবোধক । সাধুবচনের দুই অর্থ হইতে পারে । সাধারণ সন্ধি সমাসে হইতে পারে, সাধু’র (কহিত) বচন – ইহা এই সাধুবচনের অর্থ নহে – সেইরূপ হইবার কোন কারনও নাই, আমি সাধুজন নহি । তাহা হইলে হইতে পারে, “সাধু ভাষায় রচিত বচন” – ইহা সত্য বটে, আমি এইখানে সাধুভাষাতেই রচিব বটে; তবে আমার বন্ধুপ্রবর ও সহকর্মী শাওন আরেফিন যেরূপ আশঙ্কা বা আশা করিয়াছেন যে, “এই খেরোপাতাটি বিলুপ্তমান শ্লোক সংরক্ষনে অগ্রনী ভূমিকা পালন করিবে। উদাহরণস্বরূপঃ মীনক্ষোভাকুল কুবলয়(!) তথাঃ মাছের তাঁড়নে যে পদ্ম কাঁপিতেছে।” — সেইরূপ হইবার কারন নাই । বরঞ্চ সাধুবচন-এ সাধুভাষার স্বাদু রূপ লইয়া সহজবোধ্য ও সর্বজনবোধ্য করিয়াই বঙ্গভাষায় মনোভাব প্রকাশ করিব । সংস্কৃত সন্ধি-সমাসের ভারে কুঁজো সাধুভাষা প্রকৃত বাংলা নয়; সংস্কৃতের জুজু সাধুভাষার উপর সিন্দাবাদের ভূতের ন্যায় চড়িয়া বসাতেই সংস্কৃতের ন্যায় সাধুভাষাও অপ্রচলিত হইয়া উঠিয়াছে ।
সাধুবচন নামের অর্থ এইরূপ কহিলেও অসত্য হইবে না যে, “সাধএর চ্চারিত বচন” । সাধুবচনে আমিই লেখিতেছি এবং আমার নাম সাধ-ই বটে । এইসকল তথ্য দিতেছি, কারন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যেইরূপ করিতাম, সেইরূপ যদি কাহারো “সাধুবচন” খেরোখাতার নামকরণের সার্থকতা নিরূপণের ইচ্ছা জাগে (কষ্টকল্পনা করিতেছি, আসলে আমি নিজেই তো সার্থকতা নিরূপনে ব্যতিব্যস্ত রহিয়াছি) তাহা হইলে সে কিছু রসদ এইখান হইতে পাইতে পারে।

অনেকেই প্রশ্ন করিবে “কি লইয়া লিখিতে বসিয়াছি?” – কারন আমাদিগের অভ্যাস এইরূপ যে কেহ কোন কিছু কহিতে আসিলে, বিশেষ করিয়া এইরূপ আঁটোসাঁটো বাঁধিয়া ওয়েবমাধ্যমে গোলোযোগ করিয়া টঙে চড়িবার আয়োজন করিলে প্রশ্ন তো করিতেই পারে, প্রশ্ন করাই সাজে । আসলে তো ইহা বিষয়হীন লিখিবার কথা – যাহা মনে চাহিবে তাহাই লেখিব; সাধের মনে যা সাধ হইবে তাহাই অত্রস্থানে সাধুভাষ্যে প্রকাশ পাইবে।
সাধুবচন নাম বটে, তাই বলিয়া কি ইহা সাধুলোকের কথা হইবে – আলবৎ নহে । ইহাতে সাধু অসাধু সকল আলোচনাই স্থান লইবে । বাংলা সাহিত্যে বিবিধকালে নানান মহান লেখক লিখিয়াছেন – যাহাদিগের রচনা কালের পুরাণ হইয়া রহিয়া গিয়াছে, বহিয়া যাইতেছে ভবিষ্যতের দিকে ক্লাসিক রূপে । ‘ক্লাসিক’ বাংলা কেহ করেন ‘চিরন্তন’, কেহ বা কহেন ‘ধ্রুপদী’ (<ধ্রুবপদী – ধ্রুব পদ যাহার) । এইসব ধ্রুপদী চিরন্তন সাহিত্য লইয়া কচিৎ সম্যক আলোচনা করিব – অর্থাৎ কি না সমালোচনা করিব । আধুনিক কালের লেখা লইয়াও করিব । আবার বর্তমান কালে আমাদিগের আশেপাশে যাহা ঘটিয়া যাইতেছে তাহা লইয়াও লেখিব । আমার এই খেরোখাতার এক অনুপ্রেরণা হইল আমারই বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগে অধ্যয়নরত অনুজপ্রতীম সতীর্থ ‘সদানন্দ’ খান মোহাম্মদ ইরতেজা ও তাহার ওয়েবব্লগ ঘাসফড়িং এর স্বপ্ন – যদস্থলে সে বিভিন্ন বিষয়ে অতিশয় প্রীতিপ্রদ উপায়ে বিবিধ বিষয়ে সুন্দর আলোচনা করিয়া থাকে । তাহার ন্যায় আমারও কখনো সাম্প্রতিক বিষয় লইয়া লিখিতে সাধ হয়, যথেষ্ট সুযোগ না হওয়ায় পূর্বে লেখা হইয়া উঠে নাই, আশা করি পরবর্তীতে হইবে ।

রচনার বিষয়বস্তু যেরূপ হইতে পারে বাঙালি, বাঙালিয়ানা, বাংলা ভাষা সেইরূপ হইতে পারে বিবিধ বঙ্গীয় ও বৈশ্বিক সাহিত্য, নাট্য, সংস্কৃতি, চলচিত্র, চালচিত্র; হইতে পারে প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, ধর্মের কথা কিংবা ধর্মতত্ত্ব, হইতে পারে ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, নৃবিদ্যা কিংবা সম্পূর্ণ নার্ড (nerd) গিক (geek) দের ন্যায় বিষয়াদি । পাঠে স্বাদ পাইলে বা ভালো লাগিলে প্রকাশ্যে বলিবেন, মন্দ লাগিলে পশ্চাতে গালাইবেন – আপত্তি করিব না :-৯

প্রবন্ধ যেইরূপ হইতে পারে লেখার ধরন তেমনি রম্য কিংবা গল্প-ও গদ্যের অপর ধারা; আমি তো সেইরূপ-ও লেখিব; আপনারা যতই উচ্চবাচ্য করেন আমি কহিব, বরং আমার সকল রচনাই অল্প-বিস্তর রম্যরসে জারিত করিতে সচেষ্ট হইব । যদ্যপি শ্রী প্রমথ চৌধুরী, শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মা (বিদ্যাসাগর নামেই যিনি অধিক পরিচিত), সৈয়দ মুজতবা আলী, আব্‌দুশ শাকুর প্রমুখের ন্যায় উইট বা রসবোধ আমার নাই (উপরন্তু তাহাদিগের সহিৎ তুলনা করিবার চেষ্টা যেরূপ পাপকর্ম হইলো তাহাও অমোচনীয়) – তথাপি আমি কিছুটা উইট রাখিবার চেষ্টা তো করিতেই পারি; মহান লেখকের দ্বারা অনুপ্রাণিত হওয়া আর যাহা হউক দূষণীয় নহে!

রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গ

বঙ্গভূমিতে অল্পবিস্তর প্রতিভা ও খ্যাতি সম্পন্ন ব্যক্তি, যাহার বৈশ্বিক পরিচিতি রহিয়াছে এমন উদাহরণ সামান্যই; কিন্তু যাহাই রহিয়াছে তাহা অতি উচ্চমানের ও গৌরবের । এমনই এক মহান বঙ্গসন্তান, সাহিত্যাকাশে রবিরূপ প্রোজ্জ্বল শ্রী শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – বিশ্বকবি হিসেবেই যাঁহার অধিক সুনাম তিনি বিশ্বদরবারে গীতাঞ্জলির প্রণেতা পোয়েট ট্যাগোর (Poet Tagor) হিসেবেই সবিশেষ পরিচিত । কিন্তু শুধু ‘গীতাঞ্জলি’ কিংবা কাব্যই তাঁহার পরিচয়ের সর্বাংশ নহে, বরঞ্চ ইহা তাঁহার সৃষ্টিশীল ও মননশীল কর্মসমূহের একাংশ মাত্র।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহস্র গানের গীতিকার, অজস্র কাব্য তাঁহার রচিত যাহার উৎকৃষ্ঠ কিছু তিনি সন্নিহিত করিয়াছেন সঞ্চয়িতা‘য় । এই সঞ্চয়িতার আকারই এত বিশাল যে তাহা হস্তে লইয়া বিছানায় দেহ এলাইয়া দিয়া পাঠ করিবার উপক্রম নাহি । তাঁহার কাব্যের গুণ বড়ই উত্তম — তাহা সুপাঠ্য ও হৃদ্য কিন্তু সর্বদাই সহজবোধ্য নহে… বিশেষ করিয়া ‘সোনার তরী’ কাব্যখানি বুঝিবার জন্য যথেষ্ট ইলমের ও আলোচনার দাবি রাখে । কবি হিসেবে তিনি সফল সার্থক ও মহৎ, তাঁহার কাব্যপ্রতিভা লইয়া অধিক আলোচনার অবকাশ নাই । বাংলা কাব্যের যে ধারাকে বেগবান করিয়াছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত সেই ধারাকে তিনিই প্রতিষ্ঠা দিয়াছেন । তাঁহার রচিত গানই দুই দুইটি রাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গীত হইতেছে । এইটি যেমন তাঁহার জন্য বড় গৌরবের তেমনি আমাদিগের জন্যও এক পরম প্রাপ্তি । যদিওবা তাঁহার কিছুটা সংস্কৃতায়িত ভাবাপন্ন রূপে রচিত ‘জন গণ মন’ সঙ্গীতখানি অবাঙালির কণ্ঠে এমনই উচ্চারণ লইয়াছে যে তাহাকে বাংলা বলিয়া বোধ হয় না । বাংলাদেশেও ‘আমার সোনার বাংলা’ সর্বদা সঠিক স্বরলিপিতে গীত হয় নাই।

কবি ও কাব্য রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের বৃহৎ অংশ – তাঁর পরিচয় কবি হিসেবে । কিন্তু বস্তুত তাঁহার পরিচয় হওয়া উচিৎ সাহিত্যিক হিসেবে, সাহিত্যের সকল ধারাতেই তাঁহার সাবলীল বিচরণ । বিশেষ করিয়া ছোটগল্প   যেন তাঁহার কলমে বহিয়াই বাংলা সাহিত্যের জগতে প্রবেশ করিয়াছে । সাধারণত এইরূপই পরিলক্ষিত হয় যে, যে লেখক সাহিত্যের এক বিশেষ ধারার সূচনা করিতে প্রচেষ্ট হন সেই ধারা তাঁহার দ্বারাই পূর্ণতা লাভ করে না । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরে ছোটগল্প সেইরূপ হয় নাই; ছোটগল্পের স্বপ্রদত্ত সংজ্ঞা “শেষ হইয়াও হইলো না শেষ” – এর প্রকৃষ্ঠ প্রয়োগই তিনি করিয়াছেন । তিনি সর্বপ্রকার উদাহরণ দিয়া দেখাইয়া দিয়াছেন সাহিত্যের এই বিশেষ প্রকরণ কিরূপ হইলে উত্তম হয় । তাঁহার ছোট গল্পের মধ্যে সকলের অবশ্য পাঠ্য করা হইয়াছে (মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করিয়া) ছুটি ও হৈমন্তী, ইহা ছাড়াও তাঁহার গল্পগুচ্ছতে সন্নিবেশিত ইচ্ছাপূরণ, বলাই, রাজটিকা, কবুলিওয়ালা ইত্যাদি বস্তুতই বাংলা সাহিত্যের উৎকৃষ্ঠ সৃষ্টি; বিশেষ করিয়া ‘জীবিত ও মৃত’ গল্পের সমাপ্তির বাক্য, “কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই” — সত্যিই আমার নিকট অসাধারণ বলিয়া প্রতিভাত হইয়াছে।

নাটক ও উপন্যাসেও তিনি তাঁর দক্ষ লেখনীর ছাপ রাখিয়াছেন । ‘রক্তকরবী’ তাঁহার সর্বাধিক পরিচিত নাট্য আর “শেষের কবিতা” তাঁহার সর্বাধিক পঠিত উপন্যাস । তবে ছোটগল্প রচনায় তিনি যে সার্থকতা দেখিয়েছেন তাঁহার উপন্যাসে ঠিক ততটুকু পরিলক্ষিত হয় নাই । আবার প্রবন্ধ প্রণয়নে, চিঠি লেখায় ও বক্তব্য প্রদানে তিনি অত্যন্ত কুশলী ও সফল একজন শিল্পী । সেইযুগে খেরোখাতা বা ব্লগ লেখিবার চল ছিল না, উপায়ও ছিল না বটে । বোধ করি সেই সুযোগ ঘটিলে তিনি ব্লগার হিসেবেও অতিশয় নাম কামাইতে পাড়িতেন; অবশ্য সেক্ষেত্রে কিছু দুর্জন তাঁহার দুর্নাম করিতেও হয়তোবা ছাড়িতেন না । তিনি তো যথার্থই বলিয়াছিলেন, “রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি”।

এই তো গেল তাঁহার সাহিত্যিক রূপ, জন্মের সার্ধশত (১৫০তম) বার্ষিকীতে প্রকাশ্য শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের আবশ্যক অংশ । এছাড়া তাঁহার সম্পর্কে আরও কিছু লিখিবার ইচ্ছা লইয়া আগাইয়া যাইবো। এপ্রসঙ্গে উল্লেখ করিব যে, সাহিত্যচর্চা ছাড়া তিনি চিত্রাঙ্কন, সঙ্গীত সাধনা ও নানাবিধ শিল্পচর্চাও করিতেন । তাঁহার চিত্রাঙ্কনের অসংখ্য নমুনা বিদ্যমান – কলমের পাশাপাশি তুলির আঁচড়ে মনের ভাব প্রকাশ করিতে তিনি ভালো বাসিতেন । তাঁহার নানাবিধ সৃষ্টিশীলতা সবিশেষ আলোচনা এই সীমাবদ্ধ পরিসরে করা সম্ভব হইবে না বিধায় অনেক প্রসঙ্গই বাদ দিয়া যাইতেছি।

এইমাত্র, রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক পরিচয়ের কিছু আলোচনা করিবার প্রয়াস লইবো । সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলিকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুরবাড়ির সন্তান, কলকাতার পত্তন ও উত্থানের সহিত-ই পিরালী বামুন খ্যাত এই ঠাকুর বংশের সম্পর্ক । রবিঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন অভিজাত ও তুখোড় বণিক, আপন দক্ষতায় তিনি ছিলেন কলকাতা ও সর্ববঙ্গের শীর্ষ অভিজাত – জাহাজ ব্যবসার মাধ্যমে ও ব্রিটিশ কোম্পানীর সহিত ব্যবসায় তিনি সর্বভারতের শ্রেষ্ঠ ধনিক হিসেবে আবির্ভূত হন । দ্বারকানাথ ঠাকুর ইউরোপে গিয়ে বিভিন্ন রাজন্যদিগকে যেরূপ উপহার প্রদান করেন ও যেইরূপ আভিজাত্যের নমুনা প্রদর্শন করেন তাহা সকলকেই চমকিত করিয়া তুলে । পক্ষান্তের রবিঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন পার্থিব মোহমুক্ত পুরুষ; জমিদারি ও ব্যবসায় তার ছিল ঔদাসিন্য; পিতার বন্ধু রাজা রামমোহন রায়ের প্রবর্তিত ব্রাহ্মসমাজের সদস্য হিসেবে ও পরবর্তীতে সমাজের অধ্যক্ষ হিসেবে পারত্রিক ও ঐহিক মুক্তির উপায় হিসেবে একেশ্বরবাদী বর্ণপ্রথামুক্ত ব্রাহ্ম ধর্ম প্রবর্তন করেন তিনি । পিতা ও পিতামহ দুইজনের চরিত্র বৈপরীত্যে পরিপূর্ণ বিধায়ই সম্ভবত বীন্দ্রনাথ স্বয়ং নিজস্ব ভিন্নধরণের চারিত্রিক গুণাবলী ও আপন ধ্যান-ধারণার অধিকারী ছিলেন।

জমিদার হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রজাদরদী । কী প্রকারে সকলের ভালো হইতে পারে তাহার চিন্তাই তিনি করিতেন । নিজ জমিদারী এলাকায় কৃষকদিগের সুবিধার জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেরন কৃষি ব্যাংক । সুদ ও জামানত ব্যাতিরেকেই তিনি আপন প্রজাদিগকে ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করিতেন । তাঁহার ন্যায় অন্যান্য জমিদারসমূহ এরূপ কল্যানী ভূমিকায় আবর্তিত হইলে তৎকালে দেশের প্রভুত উন্নতি হইতো বলিয়াই বোধ হয়। তাঁহার এই ব্যাংকের ন্যায় কল্যানীয় আধুনিক ক্ষুদ্রঋণ কিংবা কষিঋণ প্রতিষ্ঠানসমূহ হইতে পারে নাই। দেশের কৃষিখাতের উন্নতিতে তিনি কৃষিশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন অনুধাবন করে তদানুজায়ী উদ্যোগীও হন ।

প্রাতিষ্ঠানিক তেমন শিক্ষা গ্রহণে তেমন ইচ্ছুক না হইলেও ঠাকুরবাড়ির ঐতিহ্য মোতাবেক বিশদ শিক্ষার্জন তাঁহার হয় এবং তিনি বিলেতে আইন পাঠ করিতেও গিয়াছিলেন কিছুকালের জন্য । তিনি বাংলা ও সর্বভারতে সুশিক্ষার প্রসারের প্রয়োজন প্রখরভাবেই অনুভব করেন এবং তিনি শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন । এই বিশ্ববিদ্যালয় বাংলায় সুশিক্ষা বিস্তারে ও সর্বভারতীয় শিক্ষার উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে । ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ও বাঙালিত্বের বিকাশেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাব প্রকট।

রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব রাজনৈতিক বিশ্বাস ছিল এবং তদানীন্তন রাজনীতিতে তাহার প্রভাবও ছিল অনেক । বাঙালি ও ভারতীয় জাতীয়তাবোধের গঠনে তিনি ভূমিকা রাখেন । বিবিধ প্রসঙ্গে তিনি ব্রিটিশ রাজের সমালোচনা করিতেন । অমৃতসর হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে তিনি ব্রিটিশরাজদত্ত নাইটহুড খেতাব পরিত্যাগ করেন এবং এইজন্যই তাঁহার নামের পূর্বে স্যার শব্দখানি লিখিত হয় না । তিনি বঙ্গভঙ্গের সমালোচনা করেন আবার হিন্দুত্ববাদের তিনি সমর্থক ছিলেন না । তাঁহার রাজনৈতিক অবস্থান বোঝা তাই ছিল কিছুটা জটিলতাপূর্ণ।

বিবিধ কারনেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালির এক অমূল্য সম্পদ । তিনি প্রথম অ-ইউরোপীয় হিসেবে তিনি নোবেল পুরষ্কার পান । ড. অমর্ত্য সেন ও ড. ইউনূসের পূর্বে বহুকাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন একমাত্র বাঙালি নোবেল লরিয়েট।

রবীন্দ্রনাথ বাঙালিত্বের অহংকার – এই অহংকার আজ বানিজ্য হইয়া যাইতেছে । সার্ধ শতবার্ষিকীতে আসিয়া বাংলাদেশ-ভারত যৌথ জয়ন্তী উদযাপন হইলেও আজ উত্তারাধুনিক বাঙালিয়ানা দেখিলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অভিভূত হইতেন; খুবই আনন্দের বিষয় এই যে এইরূপ আদিখ্যেতা সমূহ তাঁহাকে দেখিতে হয় নাই । অনেক কাল ধরিয়েই রবীন্দ্র চর্চাকারীগণের মধ্যে অতি ভাবালুতা দেখা গেলেও অধিকাংশ রবীন্দ্রদোদ্ধা বাঙালির সঠিক রূপ দিয়া যাইতেছিলেন । কিন্তু আজিকে রবীন্দ্রনাথের প্রতি বাঙালির ভালোবাসাকে পুঁজি করিয়া ব্যবসা হইতেছে । আজকাল উদ্‌ভ্রান্ত উত্তরাধুনিক বাঙালি বালক বালিকার কন্ঠে রবিঠাকুরের প্রশংসাবাক্য ধ্বনিত হয় এই রূপে, “ওঃ! ট্যাগোর ইজ গ্রেট; হিজ গিঠান্‌জালি ইয অ্যাজ্‌ গুড অ্যাজ্‌ শেক্‌সপীয়র” । আজিকে রবীন্দ্রপ্রেমী বৈশ্বিক বাঙালি নতুনভাবে রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করিল এক ফ্যাশন শোতে যেখানে তাহারা আসিল পাশ্চাত্যের পোশাক পরিধান করিয়া । দুই একখান তাও ফিউশান পাঞ্জাবি ও শাড়ির ন্যায় দেখিতে পোশাক পড়িয়া তাঁহারা ‘ট্যাগোর’কে বিশ্বদরবারে তুলিয়া ধরিতে গিয়া নামাইয়া আনিলেন ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক অনেক বড় বিষয়, তাহার কৃতকর্মের সম্মাননা আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয় ‌— সেইরূপ সাধ্য নাই তাই সেই স্পর্ধাও নাই – তবে তাঁহার জন্মজয়ন্তীতে আজ পঁচিশে বৈশাখে কিছু লিখিয়া অন্তত নিজের কিছু মনোভাব প্রকাশের সাধ তো আছেই । তজ্জন্যই এইটুকু রচনা।

বাঙালি, বাংলা সাহিত্য, সাহিত্যিক এইসকল বিষয় লইয়া আরও লিখিবার আশা রাখি । তবে আজিকে কবিগুরু বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিস্ময়’ কবিতার কিছু অংশ উদ্ধৃত করিয়াই খোরোখাতার এই ভুক্তির সমাপ্তি টানিব:

বিশ্বজয়ী বীর
নিজেরে বিলুপ্ত করি শুধু কাহিনীর
বাক্যপ্রান্তে আছে ছায়াপ্রায় । 

… … …
… … …
… … …

ধ্বংসধারা মাঝে আজি আমার ললাট
পেল অরুণের টিকা আরো একদিন
নিদ্রাশেষে,
এই তো বিস্ময় অন্তহীন ।

… … …
… … …
… … …

জানি এ-দিনের মাঝে
কালের অদৃশ্য চক্র শব্দহীন বাজে ।

প্রাককথন

বঙ্গভাষা বা বাংলা ভাষা বাঙালির প্রাণের ভাষা — প্রায় তিরিশ কোটি বা ইহার চাইতেও অধিক সংখ্যক আদম-সন্তান বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিবিধ প্রান্তে প্রতিদিন প্রতিক্ষণে বঙ্গভাষায় কলরব করিয়া উঠে, ক্ষণে ক্ষণে মুখর হইয়া উঠে হৃদয়ের আকুল ভাব প্রকাশের তাড়নায় – বাংলায় কথা কইবার বাসনায় । বাংলা ভাষার ন্যায় সুন্দর ভাষা আর নাই; ইহার ন্যায় মনোহর নয় মানবের আর কোনো বুলি; ইহার মতন আপন নহে আর কাহারো বচন — বাংলা ভাষার রূপ যেরূপ স্বাদু বোধ হয় তেমন আর কাহারো আস্বাদ নয়। এই বাংলা ভাষার রহিয়াছে নানান রূপ, যেমন রহিয়াছে প্রাত্যহিক কথা কহিবার জন্য বিভিন্ন অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন প্রকরণ তেমনই লিখিবার ভাষাও সর্বদা একইরূপ নহে। লিখিবার দুই আদর্শ রূপ: সাধু ভাষা ও চলিত ভাষা; উভয় রূপই মান্য ও ব্যবহার্য ।

দুই-তিন শত বৎসর পূর্বে যৎকালে বাংলা ভাষায় নিয়মিত সাহিত্যচর্চা শুরু হইয়াছিল, যৎকালে বঙ্গের মানবসকল তাঁহাদের ভাষা লইয়া সম্যক প্রাতিষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করিয়া দেয়, তৎকালে সাধু ভাষাই হইয়া উঠে লেখালেখি করিবার মান ভাষা; এমনকি বিবিধ সভায় সাধুভাষায় বলিবার চল ছিল । তৎকালে অন্দরমহল ও বাহিরমহলের ভাষা ভিন্ন হইয়া পড়ে, লিখিবার ভাষা পরিশীলিত ও সুসজ্জিত হইয়া উঠে। তাই আমরা দেখিতে পাই তৎকালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ সকলেই সাধু ভাষাতেই লিখিয়াছেন । এই সময়ে কিছু কালের মধ্যে সংস্কৃত ভাষার জুজু আসিয়া বাংলার উপর ভর করিয়া বসে এবং বাংলাকে সংস্কৃতের কন্যা মনে করিয়া বহুসংখ্যক লেখক যথেচ্ছভাবে সংস্কৃত ভাষার সন্ধি-সমাস বহুল বিশাল ও দুর্বোধ্য শব্দসমূহ বাংলা ভাষায় ব্যবহার করিতে শুরু করিয়া দেন । এইরকম সময়েই প্রমথনাথ, প্যারীচাঁদ মিত্র প্রমুখ আধুনিক মনোভাব সম্পন্ন সাহিত্যিকের প্রচেষ্টায় কথ্য ভাষার-ই একটি পরিশীলিত রূপ লেখার ভাষা হিসেবেও ব্যবহারের চলন ঘটে এবং ধীরে ধীরে চলিতভাষা-ই সর্বজনগ্রাহ্য লিখিবার ও বলিবার মান ভাষা হইয়া দাঁড়ায় ।

চলিত ভাষার ব্যাপক প্রসার ও প্রচলনের পর বহুকাল অতিবাহিত হইয়াছে, ব্রহ্মপুত্র নদের বহু পানি গড়াইয়া যমুনায় পড়িয়াছে, নদীয়ার ভাষা বদলাইয়া গিয়াছে, ঢাকার লোকসংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়িয়া কোটি ছাড়াইয়াছে – তাহাও বহুকাল হইয়াছে । এতকিছু বদলাইয়াছে আর বাংলাভাষায় পরিবর্তন হয় নাই তাহা নয় । আজ সাধারণ ভাবেই বাংলাভাষার বেশ কিছু মান রূপ পরিলক্ষিত হইতেছে —

  • লিখিবার মান ভাষা অর্ধশতাধিক বৎসর কাল পূর্বের সেই চলিত ভাষাই রহিয়াছে
  • বন্ধুমহলে কহিবার ভাষা একরূপ
  • ব্যবসা-বানিজ্যে, কর্পোরেট কলচরে, আনুষ্ঠানিক প্রয়োজনে ভাষা আরেকরূপ
  • নাটকে-সিনেমায়ও ভাষা লইয়াছে ভিন্নতর রূপ
  • দলিলে দস্তাবেজে আজও অনেকস্থানেই সাধুাষার ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়

সাধুভাষার ব্যবহার কমিয়াছে বহুগুণ কিন্তু ইহা হারাইয়া যায় নাই; বিভিন্ন সময় বাংলার প্রকৃষ্ট সাহিত্যপাঠ করিতে গিয়া সাধুভাষার প্রতি আকৃষ্ট হইয়া উঠিতেছে অনেকেই । কখনোবা কেহ কেহ সাধুভাষাতেই নিজস্ব মনের কথা লিখিতরূপে ব্যক্ত করিয়া থাকে । সাধুভাষার একটি বড় গুণ ইহার অন্তর্নিহিত ছন্দ ও নিজস্ব আকর্শনীয় ভঙ্গিমা । সাধু ভাষাতে লিখিতে আনন্দলাভ হয়, ইহা পাঠে ভিন্নরকম রসাস্বাদন হয় । সাধুভাষা যেমন ভাবগম্ভীর ও অভিজাত তেমনি লঘু ও রম্য কথাও এইভাষার বলনে সহজভাবে প্রকাশযোগ্য হইয়া উঠে ।

বাংলাভাষায় প্রায়শই নিজ মনের ভাব লিখিবার ও প্রকাশ করিবার ইচ্ছা জাগিয়া উঠে আমার; আর সেক্ষেত্রে সাধুভাষার স্বাদ পাইতেও সাধ হয় । এই কারনেই সাধুভাষায় এই খেরোখাতার আবির্ভাব; এখানে আমি বিভিন্ন সময় সাধুভাষায় বিবিধ রচনা প্রকাশ করিবার চেষ্টা করিব । সকলকেই আমন্ত্রণ রইলো সাধুবচনের আঙ্গিনায় আসিয়া আমার রচনা পাঠ করিবার ও সম্ভব হইলে সাধু ভাষাতেই বিবিধ মন্তব্য করিবার ।